বেনাপোলে ভাড়াকৃত লাইসেন্সে চলে শুল্কফাঁঁকির খেলা

Share

শহিদ জয়, যশোর 
বেনাপোল বন্দরে ভাড়াকৃত লাইসেন্সে চলছে কোটি কোটি টাকার শুল্কফাঁকি খেলা। বন্দরে অব্যবহারিত ও বিভিন্ন সময় পড়ে থাকা এসব লাইসেন্স ভাড়ায় অথবা মোটা অংকের টাকায় চুক্তি নিয়ে মেতে উঠে শুল্কফাঁকিতে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভয়ংকর এই চক্রের নাম ভাই ভাই সিন্ডিকেট। বেনাপোল-পেট্রাপোল এলাকায় রাজনৈতিক পালাবদলেও থেমে নেই এই সিন্ডিকেটের কার্যক্রম। সবই যেন তাদের কারিশমা।
গোপন তথ্য মতে, শুল্কফাঁকি দিতে একেক সময় একেক লাইসেন্স ব্যবহার করা হয়। যাতে কাস্টম কোন ভাবেই বুঝতে না পারে। এজন্য ভাড়া নেওয়া হয় বিভিন্ন পড়ে থাকা বা অকেজো লাইসেন্স। আর সুযোগ বুঝে বিল অফ এন্ট্রি দাখিল করে পণ্যে খালাশ করে শুল্কফাঁকি দেওয়া হয় কোটি কোটি টাকা। এই চক্রের সাথে আবার কাস্টমস ও বন্দরের কর্মকর্তা সহ তাদের আত্মীয় স্বজন ও জড়িত বলে তথ্য মিলেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্যাক্তি মালিকানা লাইসেন্সে খুব কমই শুল্কফাঁকির কাজ হয়। কারন ভয় থাকে আটক বা ধরা খেলে লাইসেন্স হেল্ডআপ বা সাসপেন্ড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই কৌশলে এসব হোতারা অন্যের লাইসেন্স ব্যবহার করে থাকে। অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে এসব চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন স্টেশনে পড়ে থাকা বা সচল লাইসেন্স ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকায় কিনে নিয়ে লিমিটেড কোম্পানিতে রুপান্তারিত করছেন।
বেনাপোল বন্দরে এমনই কয়েকটি লাইসেন্সের সন্ধ্যান মিলেছে, এস এ ট্রেডার্স,আলী কদর এন্ড সন্স,ওমর এন্ড সন্স,নিরা এন্টারপ্রাইজ, আলেয়া এন্টারপ্রাইজ,সোনালি এজেন্সি লিমিটেড, মেসার্স সার্ভিস লাইন, পেরেন্টস ইন্টারন্যাশনাল বিসনেস সেন্টার, জারিন এন্টারপ্রাইজ, আলতাফ এন্ড সন্স। লাইসেন্স গুলো বেশিরভাগই ভাড়ায় অথবা লিমিটেড কোম্পানিতে পরিনত হয়ে বিক্রি হয়ে গেছে। এছাড়াও সুযোগ সন্ধানীরা অন্য বন্দরের লাইসেন্স রেফারেন্স হিসাবে এই বন্দরে মোটা টাকার বিনিময়ে করিয়ে নিচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়,ভাইভাই সিন্ডিকেটের চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা সিঅ্যান্ডএফ লাইসেন্সের মালিককে বুঝিয়ে মোটা টাকা দিয়ে কাস্টমসে বিল অফ এন্টি দাখিল করে থাকে। তাদের নজর থাকে বা দালালচক্রদ্বারা খুঁজে পড়ে থাকা বেশিরভাগ মহিলা ও ছোট খাট সমস্যায় থাকা সিঅ্যান্ডএফ লাইসেন্স মালিক বের করে তাদের সাথে লোভনীয় চুক্তি ও লাইসেন্স রিস্ক হিসাবে মোটা টাকায় রফদফা করে। এচাড়াও পড়ে থাকা বিভিন্ন লাইসেন্স দিয়ে বিলঅফএন্ট্রি দাখিল করে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আসছে।
উল্লেখ্য, সাবেক কাস্টম কমিশনার মো: কামরুজ্জামান গত বছর ১২ই সেপ্টেম্বর-২৪ বেনাপোল কাস্টম হাউসে যোগদান করেন। তার যোগদানের পরপরই বেনাপোল বন্দরে শুল্কফাঁকির উৎসবে মেতে উঠে। প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পিয়ন-সবাই ঘুষ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ে। এছাড়া তার অন্যতম সহযোগী সহকারী কমিশনার শরিফুল হাসান ও যুগ্ন-কমিশনার সুশান্ত পালের বিরুদ্ধে শুল্ক আদায়ের ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে করদাতাদের কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বলে এলাকায় ব্যাপক “গুঞ্জন” রয়েছে।
কাস্টমস ও বন্দর সূত্রে জানা যায়, ◊গত বছর ৩০ সেপ্টেম্বর-২৪ বন্দরের ১৭ নং শেড হতে কাগজপত্র বিহীন ৪৮৫ প্যাকেজ পণ্য চালান আটক করে। প্রায় “৩ কোটি টাকার” পণ্য রয়েছে বলে কাস্টম জানায়। তবে এই পণ্যে চালানটি এন্ট্রি ছাড়াই বন্দরে প্রবেশ করেছে বলে জানা যায়। তবে ব্যবসায়ীরা জানান, বন্দরের সিসি ক্যামেরা ও শেড ইনচার্জ মতিনকে জিজ্ঞাসা করলে বেরিয়ে যাবে কে বা কারা জড়িত।
 ৩০অক্টোবর-২৪ বন্দরের ৩১ নং শেড হতে মিথ্যা পণ্য ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা ৩ ট্রাক ফিস মিল ইনগ্রিডেন্টসের চালান জব্দ করে। প্রায় ১০ লাখ টাকার শুল্কফাঁকি দেওয়া হচ্ছিলো। যার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান শার্শার“মেসার্স শামিম এন্টারপ্রাইজ” ও পণ্যটি ছাড়করণের দায়িত্বে ছিল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট পেরেন্টস ইন্টারন্যাশনাল বিসনেস সেন্টার।
২৪ ডিসেম্বর-২৪ বন্দরের ৪২ নং শেডে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা “দুই কোটি” টাকার শুল্ক ফাঁকি দিতে নিয়ে আসা ৬৮১ প্যাকেজ ২৮ টন ফেব্রিক্স জব্দ করে বেনাপোল কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। যার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ঢাকার গাজীপুরের “শিশির নিটিং”ও পণ্যটি ছাড়করণের দায়িত্বে ছিল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট জারিন এন্টার প্রাইজ।
২জানুয়ারি-২৫ বন্দরের ৩৫ নম্বর শেড থেকে আমদানিকারক “ইউএস এন্টারপ্রাইজের”শুল্কফাঁকি দিতে নিয়ে আসা বন্দর হতে লোড হওয়া “৬০ লাখ” টাকার বিভিন্ন ধরনের সার্জিক্যাল আইটেম, ওষুধ ও সানগ্লাস পণ্যবোঝাই কাভার্ডভ্যান আটক করে আইআরএম টিম। পণ্যটি ছাড়করণের দায়িত্বে ছিল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মেসার্স আলতাফ এন্ড সন্স।
২৬জুন-২৫ রাতে বেনাপোল বন্দরের ২৬ নম্বর শেড থেকে আমদানি কারক মেসার্স দলিলুর রহমান অ্যান্ড সন্স-এর আমদানি নিষিদ্ধ ‘দুই কোটি’ টাকার বিভিন্ন প্রকার ৬০ কেজি ওষুধ,দুই বস্তা ৯৬ হাজার পিস জিলেট ব্লেড,শাড়ি-কাপড় ৬০ পিস, ২২০০ পিস মোবাইল ফোনের ডিসপ্লে ও এক কেজি ওজনের সাদা রঙের গুঁড়া পাউডার আটক করে কাস্টম। পণ্যটি ছাড়করণের দায়িত্বে ছিল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ‘সার্ভিস লাইন।
 ৩০জুন-২৫ সোমবার সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল কর্তৃক মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা চুল ও তামাকের দুই চালানে ২ কোটি ৩৬ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকি ধরা পড়েছে।
এছাড়াও ছোট খাট অনেকগুলো শুল্ক ফাঁকির চলান আটক করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তবে সাদৃশ্য কোন সিঅ্যান্ডএফ লাইসেন্স ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিধি ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি বলে জানা গেছে। তাছাড়া এসব আটক পণ্যের বিরুদ্ধে কি শাস্তি আরোপ করেছেন তারও কোন প্রেস নোট বা ব্রিফিং দেননি। তাহলে গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশ্ন থাকে সাবেক কাস্টম কমিশনার কি প্রতিটি দৃশ্যমান আটকেও বাণিজ্যে লিপ্ত ছিলো। আর এই আটক পণ্যে গুলোই বা কোথায়। বর্তমান কমিশনার কি তা খতিয়ে দেখবে প্রশ্ন ব্যবসায়ীদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সিঅ্যান্ডএফ জানান, হাতে গোনা কয়েকজন অসাধু ব্যবসায়ীকে গোপনে শুভংকরের ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। বর্তমান দায়িত্বরত কমিশনার খালেত মোহাম্মদ আবু হোসেন যোগদান করার পর বিভিন্ন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহন করেছেন। তবে পূর্বের কমিশনার কামরুজ্জামানের সেটআপে চলছে শুল্কফাঁকি।
কয়েকজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, বেনাপোল বন্দরের শেড ইনচার্জ, স্কেলের দায়িত্বে থাকা কাস্টমস কর্মকর্তা, আইআরএম টিম ও শুল্ক গোয়েন্দা হাতে গোনা ২/৩ টি প্রতিষ্ঠানের গোপন যোগসাজসে পূর্ব চুক্তি মোতাবেক শুল্ক ফাঁকি দিতে ভারত থেকে এমন পণ্য চালান আমদানি করা হয়। বাংলাদেশে এসব পণ্যের পরীক্ষণ গ্রুপ (আইআরএম) টিমের মাস্টার মাইন্ড কর্মকর্তার নির্দেশে নাম মাত্র পরীক্ষণে মোটা টাকার বিনিময়ে খালাশ হয়ে যায় সংশ্লিষ্ট চালান।
অতিদ্রুত ভাই ভাই সিন্ডিকেটের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে বেনাপোল বন্দরের শৃঙ্খলা নষ্টসহ সচ্ছ ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়বে বলে আশংকা করছেন স্বচ্ছ আমদানিকারকরা।

Read more