দুই বছর ধরে তদন্ত চলছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিমান চালানোর লাইসেন্স নেওয়ার অভিযোগে

ঢাকা টাওয়ার নিউজ ডেস্ক: মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিমান চালানোর লাইসেন্স নেওয়ার অভিযোগে দুই বছর ধরে তদন্ত চলছে ক্যাপ্টেন নূরউদ্দিন আল মাসুদের বিরুদ্ধে। ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, তদন্তে দৃশ্যমান কোনো গতিই নেই।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাইলট মাসুদের বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু ব্যবস্থা কেন নেওয়া হচ্ছে না, সে বিষয়ে জবাব নেই তাদের।
বিমানের একটি সূত্র জানিয়েছে, এই জালিয়াতির অভিযোগ ওঠার পর পাইলট মাসুদকে কারণ দর্শনোর নোটিশ দেয় কর্তৃপক্ষ। সেই থেকে তিনি পলাতক। তবে তিনি দুবাইতে অবস্থান করছেন বলে খবর দিয়েছে একটি সূত্র।

এদিকে বৈমানিক মাসুদের বিষয়ে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও কথা বলতে অনিহা প্রকাশ করছেন। তাদের এই নীরবতা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

তবে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান মফিদুর রহমান। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘তদন্ত শেষ করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বৈধ রেটিং ছাড়া বিমান পরিচালনা, মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স নিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করা এবং বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশনে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আইআর রেটিং নবায়ন করাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ ক্যাপ্টেন নূরউদ্দিন আল মাসুদের বিরুদ্ধে। অনিয়মের মাধ্যমে লাইসেন্স নিয়ে প্রায় দুই যুগ ধরে চালিয়েছেন সিভিল ও বাণিজ্যিক বিমানের ফ্লাইট। এত অনিয়ম করেও ধরাছোঁয়ার বাইরে তিনি।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ২০২২ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশনের নজরে আসে পাইলট মাসুদের জালিয়াতির বিষয়টি। জমা দেওয়া লগবুকে অনিয়ম এবং ভুল তথ্য দিয়ে লাইসেন্স পাওয়ার অভিযোগে সিভিল এভিয়েশন তাকে শোকজ নোটিশ দেয়। তবে এর উত্তর দেননি মাসুদ।

‘জালিয়াতি’ করে পাওয়া লাইসেন্সেই তিনি ২০০১ সাল থেকে বৈমানিক হিসেবে বিমান পরিচালনা করছিলেন। ক্যাপ্টেন মাসুদের এটিপিএল নাম্বার ৩২৩।
এদিকে মাসুদের জালিয়াতির তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তারা বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রনালয়ের উপসচিব আহম্মেদ জলিলের কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এই বিভাগটি আমার নয়। যুগ্ম সচিব অনুপ কুমার তালুকদারকে কল করুন। এ ধরনের বিষয়গুলো তিনি দেখেন।’ পরে যুগ্মসচিব অনুপ কুমার তালুকদারের মুঠোফোনে ফোন করা হলে তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান।

সূত্র বলছে, ক্যাপ্টেন মাসুদ বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং ৭৩৭ এর ক্যাপ্টেন হিসেবে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেন। সেজন্য তার সকল তথ্য বাংলাদেশ বিমানে জমা দিতে হয়। বিমানের নিয়োগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ বিমান থেকে সকল প্রার্থীদের তথ্যাদি যাচাই করার জন্য সিভিল এভিয়েশনে পাঠানো হয়। তখন সিভিল এভিয়েশনের যাচাই বাছাইয়ে ক্যাপ্টেন মাসুদের সার্টিফিকেটে জালিয়াতি ও অনিয়ম ধরা পড়ে।

ক্যাপ্টেন মাসুদের সিভিল এভিয়েশনে জমা দেওয়া তথ্যানুযায়ী, তিনি ২০০১ সালের ২৭ মার্চ থেকে ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ১৩৩ ঘণ্টা ১২ মিনিট ফিলিপাইনে ফ্লাই করে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক বিমান পরিচালনার লাইসেন্স নেন। তবে ২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর ক্যাপ্টেন মাসুদ সিভিল এভিয়েশনের মেম্বার এফএসআর এবং পরিচালক এফএসআর এর কাছে একটি ইমেইল পাঠান। সেখানে দেখা যায়, মাসুদ ২০০১ সালের ৪ এপ্রিল থেকে ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত ফিলিপাইনে ১৪ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট ফ্লাই করেছেন।

এদিকে সিভিল এভিয়েশন বলছে, প্রশিক্ষণকালীন সময় একজন প্রশিক্ষণনোবিশ বৈমানিক যে পরিমাণ বিমান উড্ডয়ন করতে পারে সেটা মাসিক ৪০-৫০ ঘণ্টার বেশি হওয়ার কথা নয়। ফলে ২১ দিনে ১৩৩ ঘণ্টা ফ্লাইং এবং ৭ দিনে ১১৮ ঘণ্টা ফ্লাইং করা কোনোভাবেই সম্ভব নয় এবং আইনসিদ্ধ নয়। ক্যাপ্টেন মাসুদের জালিয়াতির বিষয়টি সিভিল এভিয়েশনের এফএসআরআইএ বিভাগের পরিচালকের নেতৃত্বে গঠিত অনুসন্ধানেও ধরা পড়েছে।

অপরদিকে লগবুকের পরবর্তী পেজে ২০৫ ঘণ্টা থেকে দেখা যায় ৪১৬ ঘণ্টা। এই ২১১ ঘণ্টা ফ্লাইংয়ের কোনো প্রমাণ সিভিল এভিয়েশনে দেখাতে পারেননি ক্যাপ্টেন মাসুদ। এমনকি ক্যাপ্টেন মাসুদ ২০০১ সালের ২৭ এপ্রিলের পর ঢাকা থেকে ফিলিপাইন যাওয়ার কোনো প্রমাণ পায়নি সিভিল এভিয়েশন।

এ বিষয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ, বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘একজন বৈমানিক প্রতি মাসে কী পরিমাণ ফ্লাইং করতে পারবেন সেটারও একটা নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। এখানে স্বজনপ্রীতি, লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্য কিংবা দুর্নীতির গন্ধ রয়েছে। গত ২৩ বছরে কেন বিষয়টি কারও নজরে আসলো না সেটাও খতিয়ে দেখার বিষয়। আমি বলতে চাই, সিভিল এভিয়েশনকে আরও বেশি কঠোর হতে হবে। নজরদারি বাড়াতে হবে। কেননা একটি দুর্ঘটনা ঘটলে সেটার দায়ভার কিন্তু আমাদের ওপর চলে আসতো। কেননা লাইসেন্স তিনি সিভিল এভিয়েশন থেকে নিয়েছেন। কঠোর সাজা এবং কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হলে এসব রোধ করা সম্ভব।’
পাইলট মাসুদের বিষয়ে তদন্ত চলছে জানিয়ে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান মফিদুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা তদন্ত করেছি। কিছু অনিয়ম পাওয়া গেছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা দ্রুতই ব্যবস্থা নেবো। জালিয়াতির বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সবকিছু মিলে জালিয়াতি এবং মিথ্যা তথ্য দিয়ে লাইসেন্সপ্রাপ্ত হলে সেই বৈমানিকের লাইসেন্স বাতিলের পাশাপাশি জরিমানাও করা হবে। আমরা সম্প্রতি লাইসেন্স জালিয়াতিতে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছি। এই ক্ষেত্রেও আমরা কঠোর রয়েছি।