দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর যশোরে বদলে গেছে দখলদারিত্ব ও চাঁদাবাজির সিন্ডিকেটও

যশোর প্রতিনিধি: দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর যশোরে বদলে গেছে দখলদারিত্ব ও চাঁদাবাজির সিন্ডিকেটও। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র সিন্ডিকেট প্রধানের মাথার পরিবর্তন হয়েছে। চাঁদা আদায় হচ্ছে পুরনো স্টাইলেই। যদিও অবৈধ এ জাতীয় কর্মকান্ড প্রতিরোধে সোচ্চার যশোর বিএনপির নেতৃবৃন্দ। তারা বিভিন্ন সভা, সমাবেশে চাঁদাবাজ ও দখলদার প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছেন। তাতে সামান্য কাজ হলেও চাঁদার অধিকাংশ উৎসেই দখলদারিত্ব কায়েম করেছে দলটির পরিচয় দেয়া একটি চক্র।

সূত্র জানায়, যশোরে যুগের পর যুগ ধারাবাহিকভাবে চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব চলে আসছে। যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে সেসব দলের ক্যাডারাই মূলত চাঁদাবাজির কর্মকান্ড চালিয়ে থাকে। তাদের সাথে থাকে আরও বিপুল সংখ্যক সন্ডাপান্ডা। এসব সিন্ডিকেটের সদস্যরা শহরের মণিহার বাসস্ট্যান্ড, শংকরপুর বাসস্ট্যান্ড, খাজুরা বাসস্ট্যান্ড, পালবাড়ি মোড় ও চাঁচড়া চেকপোস্ট এলাকায় বাস, সিএনজি, হিউম্যান হলারসহ বিভিন্ন যানবাহন থেকে নিদিষ্ট হারে চাঁদা আদায় করে থাকে। এরসাথে শহরে রয়েছে আরও কয়েকটি ছোট ছোট পয়েন্ট। এসব পয়েন্টগুলোতে আদায়কারী নির্ধারিত থাকে। কয়েকটি ছোট ছোট দলে নির্ধারিত যুবকরাই ওইসব স্থান থেকে টাকা আদায় করে। তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে পয়েন্টগুলো। আর তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে সিন্ডিকেটের প্রধান ‘বড় ভাই’।

গত পনেরো বছর যাবৎ বিদায়ী সরকার সমর্থকদের ছত্রছায়ায় যশোর শহরে বেপরোয়া চাঁদাবাজি হয়েছে। প্রকাশ্যে এসব ঘটনা ঘটলেও প্রশাসনিক কোন পদক্ষেপ ছিল না। পালবাড়ি মোড় এলাকার একজন সিন্ডিকেট প্রধানের নেতৃত্বে গোটা শহরে প্রতিমাসে প্রায় অর্ধকোটি টাকা চাঁদাবাজি করা হতো। তার ডান হাত ছিলো ছাত্রলীগ নামধারী একজন। কথিত আছে আদায়কৃত এসব টাকার ভাগ পুলিশ কর্মকর্তাসহ কিছু রাজনৈতিক নেতৃবন্দের মাঝে বিতরণ করা হতো। ফলে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি চললেও প্রতিরোধমূলক কোন পদক্ষেপ ছিল না। বিষয়টি শহরবাসীর জানা ঘটনা থাকলেও ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। একইসাথে এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা শহরের এইচএমএম রোড, মুজিব সড়ক, দড়াটানা ব্রিজের দু’পাশ, বটতলামোড়, পালবাড়িমোড়, চাঁচড়ামোড় ও মণিহার এলাকার বিভিন্ন স্থান দখল করে দোকান বসিয়ে ভাড়া দিতো। দখলকৃত এসব দোকান থেকে দিন ও সাপ্তাহিক ভিত্তিতে টাকা আদায় করতো এ চক্রের সদস্যরা বলেও অভিযোগ এলাকাবাসীর।
এদিকে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার প্রধান শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়। বর্তমান আন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বিএনপির-জামায়াত নেতৃবৃন্দ চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এমনকী তারা বিভিন্ন স্থানে সভা সমাবেশে চাঁদাবাজ ও দখলদার প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিচ্ছেন এবং বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদল নেতাকর্মীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। সম্প্রতি শহরতলীর শেখহাটিমোড়ে বিএনপির একটি সমাবেশে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বিএনপির সাথে সম্পৃক্ত কোন নেতাকর্মীকে চাঁদাবাজি ও দখলদারীর কোন কাজে সম্পৃক্ত না হতে অনুরোধ জানান। আর যদি কারো বিরুদ্ধে এ জাতীয় কোন কর্মকান্ডের অভিযোগ ওঠে তাহলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে হুশিয়ারি দেন।

তারপরও বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে, চাঁদাবাজি থেমে নেই। বিগত ১৫ বছরে যেসব স্থান থেকে চাঁদা আদায় করা হতো, নতুন বাস্তবতায় সেসব স্থান থেকে চাঁদা আদায় চলছেই। শুধুমাত্র সিন্ডিকেট প্রধান বড় ভাইয়ের মাথার পরিবর্তন হয়েছে। শহরের চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের প্রধান পালবাড়ি মোড় এলাকার ওই যুবলীগ নেতা এখন নেই। সেখানে যুবদলের একজন নতুন দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। তবে পুরনো ওই নেতা পাশে থেকে নতুন নেতাকে সহযোগিতা করছেন বলেও স্থানীয় সূত্রটি জানিয়েছে। অবশ্য শহরের পয়েন্টেগুলোতে আদায়কারী ও নিয়ন্ত্রণকারী পুরনো সদস্যরাই রয়েছে। তাদের আদায়কৃত টাকা প্রতি রাতেই পৌঁছে যাচ্ছে সিন্ডিকেট প্রধানের কাছে। শহরের খাজুরা বাসস্ট্যান্ড ও বটতলা এলাকায় যারা যানবাহন ও সিএনজি থেকে চাঁদা আদায় করতো, তাদের প্রধানদেরও পরিবর্তন হয়েছে। সেখানে জুয়েল ও সোহাগের পরিবর্তে নতুন করে নাম লিখিয়েছে ঘোপ সেন্ট্রাল রোডের পুরনো এক যুবদল নেতা। একইসাথে ঘোপ, শেখহাটি, নওয়াপাড়া ও উপশহর এলাকার বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের কতিপয় যুবক খাজুরা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট গঠন প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে।
দড়াটানা ব্রিজের ঘোপ অংশের ফুটপাতের দোকানপাট থেকে টাকা আদায় করতেন একজন প্রতিনিধির আস্থাভাজনরা। এরপর তারা আদায়কৃত টাকার একটি অংশ তার জন্য বটতলা মোড়ের একটি হোটেলে রেখে দিতেন। একইসাথে ঘোপের একজন নিধিরাম সর্দার যুবলীগ নেতাসহ কতিপয় যুবকের মাঝে টাকার আরও একটি অংশ ভাগবাটোয়ারা হতো। কিন্তু গত সপ্তাহে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ ওই স্থানে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করায় টাকা তোলা বন্ধ রয়েছে। এসময়ে এইচএমএম রোডের দখলদার উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং বিগত সিন্ডিকেটের সহযোগীরা আত্মগোপনে রয়েছেন। এছাড়া, মণিহার ও শংকরপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা যুবদলের স্থানীয় একটি গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। সেখানে তারা চাঁদাবাজিসহ ইচ্ছামত কর্মকান্ড পরিচালনা করছে বলে সূত্র জানিয়েছে। ইতিমধ্যে শংকরপুর বাস টার্মিনালের ইজারা ওই পক্ষের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। পৌরসভার টেন্ডারে অন্য কেউ অংশ গ্রহণ করতে পারেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে, শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগের পর বিভিন্ন এলাকার আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা আত্মগোপনে চলে যান। এরপর তারা বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের শেল্টারে এলাকায় ফিরে এসেছেন। তারা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে প্রকাশ্যে রয়েছেন। এ অবস্থা সবচেয়ে বেশি নওয়াপাড়া ইউনিয়নে। শেখহাটি অঞ্চলের এক যুবদল নেতার শেল্টারে রয়েছেন বিগত সরকার সমর্থিত অস্ত্রধারী ক্যাডাররা। যদিও ওই নেতার সাথে রয়েছে ক্যাডারের আত্মীয়তার সম্পর্ক। এ নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ ঘটনায় তারা বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের কাছে অভিযোগ করবেন বলেও সূত্রটি জানিয়েছে।

 

এ ব্যাপারে জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, বিএনপির নাম ভাঙিয়ে যদি কোন নেতাকর্মী এ জাতীয় ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত হয়, তবে তাদের নাম প্রকাশ করতে হবে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে খোঁজ নিয়ে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে দল থেকে তাদের কোন ছাড় দেয়া হবে না।
এ বিষয়ে কথা হয় বিএনপির কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের সাথে। তিনি বলেন, যশোর জেলা বিএনপির নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের কোন অভিযোগ তাদের কাছে নেই। তবে যদি কেউ এ জাতীয় কর্মকান্ডে যুক্ত হয়ে থাকেন তবে তাদের বিরুদ্ধে গঠনতান্ত্রিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রয়োজনে তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হবে।
বিষয়টি নিয়ে যশোরের পুলিশ সুপার জিয়াউদ্দীন আহমেদ বলেন, যশোরের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে পুলিশি তদন্ত চলছে। এসব ব্যাপারে দ্রুত অভিযান শুরু করবে পুলিশ। যশোরে চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, অপরাধীদের ঠাঁই হবে না বলে তিনি দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।