যশোর প্রতিনিধি
আজ১০ জানুয়ারি এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ কৃষক নেতা কমরেড আব্দুল মতিন মূনীর এর ২১তম প্রয়াণ দিবস। কমরেড মূনীর ১৯৪০ সালে ঝিনাইদহ জেলার রঘুনাথপুর ইউনিয়নের নিজ তোলা গ্রামে একটি ধনী কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিকভাবে তাঁর নাম রাখা হয়েছিলো আবুল বাশার। পরবর্তীতে নামটি ঢাকা পড়ে যায় তাঁর পার্টি টেক নামের আড়ালে।
গ্রামের বিদ্যালয়ে প্রাথমিক পাঠ শেষে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে এসে ভর্তি হন যশোরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুসলিম একাডেমী হাই স্কুলে। ১৯৫৭ সালে বিজ্ঞান শাখা থেকে প্রথম বিভাগে র্উত্তীন হয়ে ভর্তি হন তৎকালীন যশোর কলেজে (বর্তমান যশোর এমএম কলেজ)। এখান থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাশ করে ভর্তি হন বিএসসিতে। কারাগারে থাকা অবস্থায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বিএসসি পাশ করেন।
স্কুল জীবনে থাকতেই প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। কলেজ জীবন শুরুর সাথে সাথে জেলার পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সারির ছাত্র নেতায় পরিনত হন। ১৯৬৪ সালে এমএম কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। তাঁর কেবিনেটের জিএস ছিলেন প্রয়াত বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলাম।
১৯৬৪ সালেই তিনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের নিষিদ্ধ ঘোষিত পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্কিত হয়ে পার্টি গ্রুপে সংগঠিত হন। কমরেড মূনীর ছিলেন অসম্ভব জনপ্রিয় একজন ছাত্র নেতা। তিনি তাঁর পোষাক-পরিচ্ছদে ছিলেন খুবই আধুনিক। সেই সময়ে শহরের সবাই তাকে চিনতো একজন স্টাইলিশ ছাত্রনেতা হিসাবে।
১৯৬৭ সালে তৎকালীন দেশ রক্ষা আইনে জেলার অন্যান্য ছাত্রনেতৃবৃন্দ ও শিক্ষকদের সাথে তিনিও গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৮ সালে জেল থেকে মুক্তি পাবার পর পার্টি নির্দেশনায় ন্যাপের সাথে যুক্ত হন। ৬৮-৬৯ এর গণআন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এই সময়ে নোওয়াপাড়া বেঙ্গল টেক্সটাইল মিলের শ্রমিকদের সংগঠিত করে শ্রমিক আন্দোলনকে এগিয়ে নেবার চেষ্টা করেন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আক্রমনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বে কমরেড তোজো, কমরেড আসাদ, কমরেড শান্তি, কমরেড মানিক, কমরেড ফজলুকে নিয়ে একটি বাহিনী গঠিত হয়। এরা ছিলেন সেই সময়ে শহরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কমরেড। তাঁরা কেশবপুর-মনিরামপুর এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনা করেন। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পরবর্তীতে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এসে রাজাকাররা এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকে।
এমন পরিস্থিতিতে কমরেড মূনীর তাঁর বাহিনীসহ খুলনার ডুমুরিয়া থানা অ লে চলে যান। অক্টোবরের মধ্যভাগে তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যশোর শহরে ফিরে আসার। অন্য কমরেডদের আশ্রয়স্থল খোঁজার লক্ষ্যে তিনি যশোর শহরে চলে আসেন। ২৩ অক্টোবর মনিরামপুরের চিনেটোলায় কমরেড তোজো, কমরেড আসাদ, কমরেড শান্তি, কমরেড মানিক ও কমরেড ফজলু রাজাকারদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।
১৯৭২ সালে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিকে বৃহত্তর যশোর জেলায় পুনরায় সংগঠিত করার লক্ষ্যে ৫ সদস্যের সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে কমরেড মূনীর এই কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ’৭৫ সালে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন।
১৯৭৩ সালে ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ ও সদরের অংশবিশেষে গোলা দখল ও ফসল দখলের যে লড়াই গড়ে ওঠে তিনি নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন। ’৭৬ সালে বাংলাদেশ প্রশ্নে পার্টি অভ্যন্তরে তিনি বির্তকের সূত্রপাত করেন। শ্রেণী শত্রু খতমের বিপরিতে সস্ত্রত্র গণঅভ্যুথানের লাইনকে সামনে নিয়ে আসেন। মতাদর্শগত বিতর্কের একটি পর্যায়ে ১৯৮০ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে পার্টি প্লেনাম অনুষ্ঠিত হয়। এই প্লোনামের মাধ্যমে কমরেড মূনীর বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পার্টি মূলত দুটি কেন্দ্রে বিভক্ত হয়। একটি অংশ ‘হক’ গ্রুপ এবং অন্য অংশটি ‘মূনীর’ গ্রুপ হিসাবে পরিচিতি পায়। দেশের দক্ষিন-পশ্চিমা লে তিনি ছিলেন একজন অপ্রতিরোধ্য কমিউনিস্ট নেতৃত্ব।
১৯৮৪ সালে প্রয়াত খালেদুর রহমান টিটো’র যশোর পৌরসভা নির্বাচন পরিচালনার মাধ্যমে তিনি প্রকাশ্যে রাজনীতিতে আসেন। তার আগ পর্যন্ত তিনি আত্মগোপনে ছিলেন।
ঐক্যবদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের প্রক্রিয়াতে তিনি বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট লীগ, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ ও ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে কাজ করেন।
স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের শুরুতে কেন্দ্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ’৯১ সালের নির্বাচনে সাত দলের প্রার্থী হিসাবে ঝিনাইদহ সদর আসনে নির্বাচন করার প্রস্তাবনা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। কমরেড মূনীর তাঁর সমস্ত রাজনৈতিক জীবনে আপোসের কোন স্থান দেননি। শেষ র্মুহুত পর্যন্ত তিনি বিশ্বাস করতেন বল প্রয়োগের মাধ্যমেই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে হবে। মাঝামাঝি অন্যকোন পথে নয়। তিনি তাঁর এই বিশ্বাসে ছিলেন দৃঢ়।
তিনি ছিলেন ভিষণরকম একজন কর্মীবান্ধব কমরেড। কর্মীরা তাঁর কাছে ছিলো সবচেয়ে প্রায়োরিটির জায়গায়। পরিবারকে তিনি রাজনীতির অধীন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে পার্টি সিদ্ধান্তে তৎকালীন পার্টি কর্মী মনোওয়ারা সিদ্দিকীর সাথে তার বিয়ে হয়। পরিবারের সকল সদস্যকে তিনি তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শে গড়ে তুলতে সক্ষম হন। পৈত্রিক সূত্রে তিনি প্রায় ২৫০ বিঘা জমির মালিকানা পান। যার সিংহভাগই ব্যয় করেন রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনায়।
১৯৯৫ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে বিযুক্ত হন এবং জাতীয় গণফ্রন্ট গঠনে ভূমিকা পালন করেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত গণফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। সমগ্র পার্টি জীবনে পার্টি শৃঙ্খলা রক্ষায় তিনি ছিলেন অনন্য। তাঁর উপর চাপিয়ে দেওয়া অনেক ভুল সিদ্ধান্ত পার্টি শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে তিনি মেনে নেন। ২০০২ সালের ০১ জানুয়ারী রাতে তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির গণ কনভেনশনে যোগদানের উদ্দেশ্যে যশোর থেকে ঢাকা আসেন।
০৯ জানুয়ারী পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠনের সাথে আলোচনায় সংগঠনের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন। ১০ জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে মাওলানা ভাসানী পরিষদের একটি আলোচনাসভায় আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। এখানেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে প্রথমে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখান থেকে তাকে হৃদরোগ ইন্সটিটিউট হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুর সময় পরিবারের কেউ পাশে থাকার সুযোগ না থাকলেও তিনি তাঁর পরিবারের চেয়েও প্রিয় রাজনৈতিক সহযোদ্ধাদের কোলে মাথা রেখেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।