আ.লীগের সঙ্গে সখ্য গড়ছেন ঢাবির উপ-উপাচার্য, অভিযোগ বিএনপিপন্থিদের

Share

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন আহমেদ আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিএনপিপন্থি এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেছেন বিএনপিপন্থি সাদা দলের শিক্ষকরাই।

সাদা দলের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করেছেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুন, এমন অভিযোগ করেছেন সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান। তিনি বলেছেন, তারেক রহমান ইতোমধ্যে আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিছু মানুষ দল থেকে সবসময় সুবিধা নিয়েছেন। তারা কেউ দলের লোক না। এটি এখন আবারও উন্মুক্ত হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা যে দল ভাঙতে পারেননি। মামুন আহমেদ সেই দল ভেঙেছেন!

অভিযোগ উঠেছে, অধ্যাপক মামুন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক পদে ছাত্রলীগের কুয়েত-মৈত্রী হলের সহ-সভাপতি সাদিয়া আফরিন এনিকে নিয়োগ দিয়েছেন। এ ছাড়াও দুর্যোগ ব্যবস্থা ইনস্টিটিউটে নকলের দায়ে অভিযুক্ত এক শিক্ষার্থীকে প্রভাষক পদে নিয়োগের চেষ্টা করেছেন।

বিএনপিপন্থি শিক্ষকরা আরও অভিযোগ করেন, উপ-উপাচার্য মামুন আহমেদ আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সঙ্গে ‘যোগসাজশ’ করে একটি নিজস্ব বলয় তৈরির চেষ্টা করছেন। সেকারণে তিনি নীল দলের একাধিক শিক্ষক এবং জুলাই অভ্যুত্থানের পর পদত্যাগকৃত উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগসহ একাধিক বিষয়ে অধ্যাপক মামুন বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের পরিবর্তে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের প্রাধান্য দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে সাদা দলের শিক্ষকদের।

এসব অভিযোগের বাইরেও অধ্যাপক মামুন আহমেদের বিরুদ্ধে আওয়ামীপন্থি নীল দলের শিক্ষকের সঙ্গে বিদেশ সফর, রিসার্চ এক্সিলেন্স অনুষ্ঠানে নীল দলের শিক্ষকদের পুরস্কার প্রদান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও নীল দলের শিক্ষক অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিককে তার স্মরণসভায় তোষণের অভিযোগ করেছেন এই শিক্ষকরা।

অভিযোগের বিষয়ে মামুন আহমেদ গত বলেন, আমার কাছে বিভিন্নজন (সাদা দলের শিক্ষক) নানাভাবে সুপারিশ করতে চেয়েছেন; আমি গ্রহণ করিনি। আমার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ, তার মূল কারণ এটি। এমনকি এজন্য কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান খানকে আমি রুম থেকে বের করে দিয়েছি।

অবশ্য মামুন আহমেদের সঙ্গে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান খান। তিনি জানিয়েছেন, মামুন আহমেদ আমাকে বের করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন কীভাবে? তাছাড়া একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি এ ভাষায় কথা বলতে পারেন না।

তিনি বলেন, কলা অনুষদের একটি নিয়োগ বোর্ডে আমরা দুবার বসেও নিয়োগে একমত হতে পারিনি। সেখানে পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. শান্তু বড়ুয়া একটি মেয়েকে সুপারিশ করেছেন। মামুন আহমেদ ওই মেয়েকে ছাড়া অন্য কাউকে নিয়োগ দিতে চান না। অথচ ওই মেয়ে ছাত্রলীগের পদধারী এবং বিভাগে তাকে নিয়ে কিছু যৌন স্ক্যান্ডালও রয়েছে। ওনাকে আমি এই কাজগুলো দেখেশুনে করতে বলেছি। বোর্ডের বাইরে ওনার সঙ্গে আমার আর কোনো কথা হয়নি।

সাবেক উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামালসহ অন্যান্য নীল দলের শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠকের বিষয় অস্বীকার করেছেন অধ্যাপক মামুন আহমেদ। তিনি বলেন, অধ্যাপক মাকসুদ কামাল ও নিজামুল হক ভূঁইয়া স্বৈরাচারের দোসর ছিলেন। তাদের সঙ্গে আমি গোপনে বৈঠক কী কারণে করব!

তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে যারা অপরাধ করেছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। তাদের সঙ্গে আমি কেন ব্যক্তিগত, পেশাগত, প্রশাসনিক সম্পর্ক খারাপ করব?

ছাত্রলীগ নেত্রীকে নিয়োগের বিষয়ে মামুন আহমেদ বলেন, কেউ ছাত্রলীগ করেছেন কি না, এটা তো উপ-উপাচার্যের পক্ষে জানা সম্ভব নয়, যদি না নিয়োগ বোর্ড ও অন্যান্য শিক্ষকরা জানান। কেউ কি আমাকে আগে কিছু জানিয়েছেন?

অবশ্য সাদা দলের শিক্ষকরা বলছেন, বিভিন্ন মাধ্যমে মামুন আহমেদকে এসব বিষয়ে জানানো হয়েছে। কিন্তুই তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি।

নীল দলের শিক্ষক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে মামুন আহমেদ বলেন, জাপানের কোবে বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে সম্পূর্ণ খরচ দিয়ে তাদের একটি আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামে ডেকেছিল। সেখানে যাওয়ার জন্য যে প্রশাসনিক কার্যক্রম সম্পন্ন করা প্রয়োজন, তা আমি জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যানকে দিয়েছি। এখানে অন্য কেউ চেয়ারম্যন হলে তাকেই এই দায়িত্ব দিতাম।

উপ-উপাচার্যের কার্যালয়ে বাকবিতণ্ডা
এসব অভিযোগকে কেন্দ্র করে গত ২২ জুন সাদা দলের শিক্ষকরা একত্র হয়ে উপ-উপাচার্য মামুন আহমেদের কার্যালয়ে যান। এ সময় সাদা দলের যুগ্ম-আহ্বায়ক অধ্যাপক আব্দুস সালাম, অধ্যাপক আবুল কালাম সরকার, ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিনসহ ২০ জনের বেশি শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন।

সেখানে সাদা দলের শিক্ষকরা তাদের এই অভিযোগগুলো তুলে ধরেন এবং উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মামুনের কাছে জবাবদিহিতা চান। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে এই বৈঠক চলে। বৈঠকে মামুন আহমেদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ান কয়েকজন শিক্ষক। পরে তারা ৭ দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে উপ-উপাচার্যের কার্যালয় ছাড়েন।

বৈঠক শেষে সাদা দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল কালাম সরকার বলেন, উপ-উপাচার্যের কাছে সারা দুনিয়ার খবর থাকে। কেবল কে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তা উনি জানেন না। আজকের সাক্ষাতে আমাদের অভিযোগের বিষয়ে আমরা সরাসরি জবাব চেয়েছি।

অভিযোগের শুরু
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোটাদাগে শিক্ষকদের দুটি দল সক্রিয়। আওয়ামীপন্থি শিক্ষকরা নীল দল এবং বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষকরা সাদা দল করেন।

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর সাদা দলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৫-২৬ সেশনের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খানকে আহ্বায়ক এবং বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক আব্দুস সালাম ও ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক আবুল কালাম সরকারকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়।

নতুন এই কমিটির বিরুদ্ধে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার অভিযোগ আনে সাদা দলের পদবঞ্চিত একটি অংশ। পদবঞ্চিত অংশটি একইদিন সাদা দলের আরেকটি কমিটি ঘোষণা করে। কমিটিতে অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম তালুকদারকে আহ্বায়ক এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ আল মুজাদ্দেদী আলফেছানী ও অধ্যাপক মুহাম্মদ মেজবাহ্ উল ইসলামকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়।

‘সাদা দলকে বিতর্কিত করতে’ অধ্যাপক মামুন আহমেদের সমর্থনে এই কমিটি গঠন হয় বলে মোর্শেদ হাসানের নেতৃত্বাধীন অংশ অভিযোগ করে। তারা জানান, আমিনুল ইসলাম তালুকদার নেতৃত্বাধীন অংশ উপ-উপাচার্যের কার্যালয়ে বসে নতুন কমিটি গঠন ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন।

মোর্শেদ হাসানের কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক আবুল কালাম সরকার বলেন, সাদা দলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ১৪টি ইউনিট রয়েছে, এরমধ্যে ১২টি সক্রিয়। ১২টি ইউনিট প্রতিবছর ডিসেম্বরে নতুন কমিটির আহ্বায়ক ও উত্তর অংশ থেকে একজন যুগ্ম-আহ্বায়ক এবং দক্ষিণ অংশ থেকে একজন যুগ্ম আহ্বায়কের নাম প্রস্তাব করেন।

তিনি বলেন, এ বছর আহ্বায়ক ও যুগ্ম-আহ্বায়ক পদে সবচেয়ে বেশি ইউনিট থেকে নাম এসেছে মোর্শেদ হাসান খানের। নির্বাচনে পরাজিত হয়ে মামুন আহমেদের সহযোগিতায় আমিনুল ইসলামসহ একটি অংশ গিয়ে নতুন কমিটি ঘোষণা করে। তাদের কোনো অভিযোগ থাকলে, গঠনতন্ত্র সংস্কারের আবেদন থাকলে, তা তারা পূর্বেই করতে পারতেন। কিন্তু নির্বাচন করে পরাজিত হওয়ার পর তারা সাদা দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছেন।

অধ্যাপক আবুল কালাম সরকার আরও অভিযোগ করেন, মামুন আহমেদ দলের আহ্বায়ক হতে চাইছিলেন। কিন্তু দলে তার অবস্থান এমন যে, তিনি কখনো দলের যুগ্ম-আহ্বায়কও হতে পারেননি। যেহেতু এখানে একটা ভোটের মধ্য দিয়ে আসতে হয় এবং দলে লুৎফর রহমান, ওবায়েদুল ইসলাম ও মোর্শেদ হাসান খানদের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। এবারও নিজের লোকেদের এখানে পদায়ন করতে না পেরে নতুন দল খুলতে যোগসাজশ করেছেন।

অধ্যাপক মামুন আহমেদের ‘যোগসাজশে’ সাদা দল থেকে একটি অংশ বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই তার সঙ্গে সাদা দলের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে বলে মোর্শেদ হাসান নেতৃত্বাধীন সাদা দলের একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন।

মামুন আহমেদ দল থেকে সুবিধা নিয়েছেন
এ বিষয়ে সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান বলেন, তারেক রহমান ইতোমধ্যে আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিছু মানুষ দল থেকে সবসময় সুবিধা নিয়েছেন। তারা কেউ দলের লোক না। এটি এখন আবারও উন্মুক্ত হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা যে দল ভাঙতে পারেননি। তিনি সে দল ভেঙেছেন। তিনি ওয়ান-টু-ওয়ান কন্টাক্ট করেছেন।

এসব অভিযোগের জবাবে অধ্যাপক মামুন আহমেদ বলেন, সাদা দলের কয়েকজন লোক বহুদিন থেকে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রেখেছেন, এমন অভিযোগে একটি দল সাদা দলের আরেকটি কমিটি দিয়েছেন।

তিনি বলেন, আমি উপ-উপাচার্য; আমি একদলকে বলতে পারি না তোমার কেন অপরদলের বিরুদ্ধে গিয়েছ? তোমরা একত্রিত হয়ে যাও বা বিভক্ত হয়ে যাও; এতে আমার কোনো অসুবিধা নেই।

Read more