শাহারুল ইসলাম ফারদিন, যশোর: যশোর থেকে নড়াইল-ভাঙ্গা হয়ে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকা পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার সিঙ্গেল লাইন স্থাপন প্রকল্পটি সরকারের বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প। যশোর থেকে মাত্র আড়াই থেকে ৩ ঘণ্টায় রেল পথে যাওয়া যাবে রাজধানী ঢাকায়। এছাড়া যশোর-ঢাকা রুটে ১৮৫ কিলোমিটার দূরত্ব কমবে।পদ্মাসেতু যশোর-খুলনা অঞ্চলের যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। দ্রুত গতিতে চলছে ট্রেন লাইন নির্মাণের কাজ। পরিপ্রেক্ষিতে আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নতি হবে এ অঞ্চলের মানুষের। বর্তমানে যশোর থেকে ঢাকা ট্রেনে সময় লাগে ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা। নতুন এই লাইন চালু হলে সময় নেমে আসবে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টায়। এতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য যেমন সম্প্রাসরণ হবে। জীবন-মান উন্নত হবে। আর এ নিয়ে উচ্ছ্বসিত এই এলাকার মানুষ। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থার এই উন্নতিতে ওই অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতিও হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে জিডিপি আনুমানিক ১ শতাংশ বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।সূত্র জানায়, পদ্মাসেতু রেলওয়ে প্রকল্পের কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে যশোর থেকে নড়াইল হয়ে ঢাকা পর্যন্ত রেলপথে যেতে সময় লাগবে মাত্র আড়াই ঘণ্টা। ২০১৬ সালে ১ জানুয়ারি পদ্মাসেতুর রেল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০২৪ সালের ৩ জুন এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩৯,২৪৬.৮০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার বরাদ্দ দিচ্ছে ১৮,২১০.১১ কোটি টাকা এবং জিটুজি পদ্ধতিতে চীনা সরকারের কাছ থেকে ২১০৩৬.৬৯ কোটি টাকা প্রকল্পের সাহায্য নেয়া হয়েছে। রেলপথটি নির্মাণে মোট ৩৬৫ দশমিক ১০ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের সাথে ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট কমার্শিয়াল চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। প্রকল্পের প্রধান সমন্বয়ক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আব্দুল মুকিম সরকার বলেন, প্রকল্প অনুযায়ী রেলপথটি ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ হয়ে পদ্মাসেতুর ওপর দিয়ে চলে গেছে যশোর পর্যন্ত। যা ১৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে ২০টি স্টেশন আছে। যার মধ্যে নতুনভাবে নির্মাণ করা হবে ১৪টি স্টেশন। আর পুরনো স্টেশন সংস্কার করা হবে ছয়টি। তিনি বলেন, ব্রডগেজ সিঙ্গেল লাইনের এ রেলপথে ১২০ কিলোমিটার গতিতে চলবে ট্রেন। প্রকৌশলী সূত্র জানায়, ঢাকা-যশোর পর্যন্ত নতুন ১৪টি স্টেশন হলো, কেরানীগঞ্জ, নিমতলা, শ্রীনগর, মাওয়া, জাজিরা, শিবচর, ভাঙ্গা জংশন, নগরকন্দা, মুকসুদপুর, মহেষপুর, লোহাগড়া, নড়াইল, জামাদিয়া ও পদ্মাবিলা। এছাড়া সংস্কার করা হবে ঢাকা, গেণ্ডারিয়া, ভাঙ্গা, কাশিয়ানী, রূপদিয়া ও সিঙ্গিয়া রেলস্টেশন। রেলস্টেশনগুলোতে থাকবে আধুনিক সিগনালিং ব্যবস্থা। সর্বোচ্চ ২৫ টন এক্সেল লোড বহন করতে পারবে। ৬৬টি বড় সেতু ও ২৪৪টি ছোট সেতু নির্মাণ করা হবে। রেলপথ ও সড়কের বিভাজনে থাকবে আন্ডারপাস, অপটিক্যাল ফাইবারের টেলিযোগাযোগ, ভায়াডাক্ট, রুফ ওয়ে, রেলক্রসিং, রেল ওভার ব্রিজ, প্রকল্প কার্যালয় ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র। রেললাইনে যুক্ত হচ্ছে এলাসট্রেস ট্রাক, যা আগে কখনো হয়নি। ট্রপোগ্রাফিক সার্ভে, হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভে, সয়েল ইনভেস্টিগেশনের কাজগুলো শেষের দিকে। সয়েল টেস্ট শেষ হওয়ার পর মূল ডিজাইনের কাজ শুরু হবে। প্রকৌশল বিভাগের প্রধান সমন্বয়ক মেজর জেনারেল আবু সাঈদ মাসুদ বলেন, সিএসসি (কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্ট), বাংলাদেশ রেলওয়েকে সাহায্য করেছে ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অফ দ্যা রুরাল পোর (ডিওআরপি) নামে একটি এনজিও। সিএসসি এখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ দেশি ইঞ্জিনিয়ার ও বিদেশি পরামর্শক, বুয়েট দ্বারা গঠিত। প্রকল্পটির জন্য ১৭০০ একরের মতো জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা যাতে যথাযথ ক্ষতিপূরণ পায় সেজন্য কাজ করছে ডিওআরপি। আবাদি জমির যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখা হয়েছে। প্রকৌশল সূত্র জানায়, ২৩ কিলোমিটার এলিভেটেড ভায়াডাক্টে ব্লাস্টবিহীন রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এলিভেটেড ভায়াডাক্টের ওপর ২টি প্লাটফরম, একটি মেইন লাইন ও দুইটি লুপলাইনসহ রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণ ও তাতে লিফট স্থাপন করা হবে। প্রায় ১১ মিটার উঁচু রেললাইনের নিচ দিয়ে সড়কের জন্য আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে যাতে উভয় পথে নিরবচ্ছিন্ন ও নিরাপদে ট্রেন, গাড়ি চলাচল করতে পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সফট সয়েল ট্রিটমেন্টের জন্য সিমেন্ট মিক্স পাইল ব্যবহার, সেতুর অ্যাপ্রোচ ট্রানজিশনাল কার্ভ ও ৩০টি লেভেল ক্রসিং গেট নির্মাণ করা হচ্ছে। কম্পিউটার বেজড সিগন্যালিং ব্যবস্থা রাখা হবে ২০টি স্টেশনে, কেন্দ্রীয়ভাবে ট্রেন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকবে ঢাকা স্টেশনে। ব্রডগেজের জন্য ১০০টি যাত্রীবাহী গাড়ি সংগ্রহ করা হবে। গত বছরের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাওয়ায় এসে পদ্মাসেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।