নিজস্ব প্রতিবেদক: শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে ‘শবেবরাত’। সেই হিসেবে এ বছর মহিমান্বিত রজনী লাইলাতুল বরাত মঙ্গলবার (৭ মার্চ)। পবিত্র শবেবরাত মাহে রমজানেরও আগমনী বার্তা দেয়। যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদায় ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে এদিন দিবাগত রাতে সারাদেশে পবিত্র শবেবরাত পালিত হবে।
মহিমান্বিত এই রাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পরম করুণাময় মহান আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের আশায় নফল নামাজ পড়েন, কোরআন তিলাওয়াত করেন এবং জিকিরে মগ্ন থাকেন। অতীতের পাপ-অন্যায়ের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা এবং ভবিষ্যৎ জীবনের কল্যাণ কামনা করে মোনাজাত করবেন মুসলমানরা।
আরও পড়ুন: শবেবরাতেও ক্ষমা পাবেন না যারা
পবিত্র শবেবরাত মুসলমানদের কাছে পবিত্র রমজানের আগমনী বার্তাও নিয়ে আসে। তাই শবেবরাত থেকেই আসন্ন পবিত্র রমজানের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। আরবি দিনপঞ্জিকা অনুসারে, শাবান মাসের পরে আসে পবিত্র রমজান মাস।
পবিত্র শবেবরাত উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, মানুষের ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির জন্য ইসলামের সুমহান আদর্শ আমাদের পাথেয়। এই পবিত্র রজনীতে আমরা সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে অশেষ রহমত ও বরকত কামনার পাশাপাশি দেশের অব্যাহত অগ্রগতি, কল্যাণ ও মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর ঐক্যের প্রার্থনা জানাই।
আরও পড়ুন: শবেবরাতে মুক্তি লাভে যে দোয়া পড়তে বলেছেন বিশ্বনবি
পবিত্র শবেবরাত উপলক্ষে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব মুসলমানকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে মানবকল্যাণ ও দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে শবেবরাতের পবিত্রতা রক্ষার্থে এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপন নিশ্চিত করতে বিস্ফোরক দ্রব্য, আতশবাজি, পটকাবাজি, অন্যান্য ক্ষতিকারক ও দূষণীয় দ্রব্য বহন এবং ফোটানো নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
মহিমান্বিত রজনী শবে বরাত
রমজান মাসে পবিত্র কোরআন শরিফের এক মিলিয়ন কপি বিতরণ করবে সৌদি আরব। প্রায় ৭৬টি ভাষায় কোরআনের তরজমা করা কপি বিতরণ করা হবে। সৌদি বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ এর অনুমোদন দিয়েছেন।
রোববার (৫ মার্চ) সৌদি প্রেস এজেন্সি (এসপিএ) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কোরআনের এই কপিগুলো বিভিন্ন ধরনের হবে। কোরআনের কপিগুলো মদিনার কিং ফাহাদ কমপ্লেক্সে তৈরি করা হয়েছে। সৌদি আরবের ইসলাম ও দাওয়াহবিষয়ক মন্ত্রণালয় রমজানে ২২টি দেশের ইসলামিক সেন্টারের মাধ্যমে কপিগুলো বিতরণ করবে।
সৌদি আরবের ইসলামি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও কিং ফাহাদ কমপ্লেক্সের প্রধান ড. আবদুল লতিফ আল শায়েখ বলেছেন, সৌদি আরব বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে পবিত্র কোরআনের বাণী পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
তিনি আরও বলেন, মন্ত্রণালয় ২২টি দেশে সৌদি দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে যত্নসহকারে কোরআন ও কোরআনের অনুবাদ করা কপিগুলো পৌঁছে দেবে।
শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে ‘শবেবরাত’। শবেবরাত অর্থ মুক্তির রাত। শবেবরাতের আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’। হাদিস শরিফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা ‘শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী’ বলা হয়েছে। শবেবরাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ তাৎপর্যময় রজনী। এ রাতে মহান আল্লাহ তা’য়ালা তার রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন।
ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, শয়তানের কুমন্ত্রণায় বা নফসের তাড়নায় মানুষ বিপৎগামী হয় বা পাপাচারে লিপ্ত হয়। মানুষের পাপমোচনের জন্য আল্লাহ তা’আলা তওবা ও ইস্তিগফারের ব্যবস্থা রেখেছেন। বিশেষ কিছু দিবস ও রজনী দিয়েছেন, এর মধ্যে অন্যতম ও বিখ্যাত হলো শবেবরাত।
পবিত্র কোরআনের বলা হয়েছে, ‘হা মিম! শপথ! সুস্পষ্ট কিতাবের, নিশ্চয় আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে। নিশ্চয়ই আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয় আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি। এ হলো আপনার প্রভুর দয়া, নিশ্চয়ই তিনি সব শোনেন ও সব জানেন। তিনি নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এ উভয়ের মধ্যে যা আছে, সেসবের রব। যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাস করো, তিনি ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই, তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান, তিনিই তোমাদের লালনপালনকারী আর তোমাদের পূর্বপুরুষদেরও। তবু তারা সংশয়ে খেলা করে। তবে অপেক্ষা করো সেদিনের, যেদিন আকাশ স্পষ্ট ধোঁয়াচ্ছন্ন হবে।’ (সুরা দুখান, আয়াত: ১-১০)।
মুফাসসিরিনগণ বলেন, এখানে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনী বলে শাবান মাসে পূর্ণিমা রাতকেই বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি, রুহুল মাআনি ও রুহুল বায়ান)। হজরত ইকরিমা (রা.) প্রমুখ কয়েকজন তাফসিরবিদ থেকে বর্ণিত আছে, সুরা দুখান-এর দ্বিতীয় আয়াতে বরকতের রাত বলে শবেবরাতকে বোঝানো হয়েছে। (মাআরিফুল কোরআন)।
হজরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সিজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ করে বললেন, ‘হে আয়শা! তোমার কি আশঙ্কা হয়েছে?’ আমি উত্তরে বললাম, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘তুমি কি জানো এটা কোন রাত?’ আমি বললাম, ‘আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলই ভালো জানেন।’ তখন নবীজি (সা.) বললেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তা’আলা তার বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন, ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।’ (শুআবুল ইমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮২)।
হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন। তিনি আরও বলেন, নবীজি (সা.) তাকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া-বকরির পশমের (সংখ্যার পরিমাণের) চেয়েও বেশিসংখ্যক গুনাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি: ৭৩৯)।
হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবি করিম (সা.) বলেছেন, ১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো; কেননা এদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং আহ্বান করেন, ‘কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছো কি? আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিকপ্রার্থী আছো কি? আমি রিজিক দেব; আছো কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি তাকে উদ্ধার করব।’ এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলা বান্দার বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ: ১৩৮৪)।
শবে বরাত উপলক্ষে রোজা রাখা, নামাজ পড়া, নামাজে কিরাত ও রুকু-সিজদা দীর্ঘ করা; কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করা; দরুদ শরিফ বেশি বেশি পড়া; ইস্তিগফার বেশি পরিমাণে করা; দোয়া কালাম, তাসবিহ তাহলিল, জিকির আজকার ইত্যাদি করা; কবর জিয়ারত করা; নিজের, পিতা-মাতার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সব মুমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করা।
এ ছাড়া মাসের প্রথম তারিখ, মধ্য তারিখ ও শেষ তারিখ নফল রোজা গুরুত্বপূর্ণ। শবে বরাতের রোজা এর আওতায়ও পড়ে। সওমে দাউদি পদ্ধতিতে এক দিন পর এক দিন রোজা পালন করলেও প্রতিটি বিজোড় তারিখ রোজা হয় এবং শবে বরাতের রোজার শামিল হয়ে যায়। সর্বোপরি রাসুল (সা.) রমজান মাসের পর রজব-শাবান মাসে বেশি নফল নামাজ ও নফল রোজা পালন করতেন, শাবান মাসে কখনো ১০টি, কখনো ১৫টি, কখনো ২০টি নফল রোজা, কখনো আরও বেশি রাখতেন। এমনকি উম্মুহাতুল মুমিনিনগণ বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসে এভাবে নফল রোজা রাখা শুরু করতেন, মনে হতো, তিনি আর কখনো রোজা ছাড়বেন না। (মুসলিম)।
সাধারণত অসতর্কতায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে থাকে। আবার আল্লাহর অবাধ্যতার মাত্রা চরম হলেও আল্লাহর পক্ষ থেকে নানান ধরনের আজাব-গজব নাজিল হয়। দুনিয়ার বিপদ-আপদ, আজাব-গজব থেকে বেঁচে থাকতে আল্লাহর স্মরণের বিকল্প নেই। তাই কোথাও আগুন লাগলে মহান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা জরুরি।
আগুন দেখে হতাশ না হয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করে তা নেভানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। অতঃপর আল্লাহর কাছে তা সহজে নির্মূলে দোয়া ও আমল করা জরুরি।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহ আনহু বর্ণনা করেন রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা যখন কোথাও আগুন (লাগতে) দেখো, তখন তোমরা তাকবির (আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার) দাও। কারণ, তাকবির আগুন নিভিয়ে দেবে। (তাবরানি)
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘আগুন যত ভয়ংকর হোক না কেন, তাকবিরের মাধ্যমে তা নিভে যায়। আর আজানের মাধ্যমে শয়তান পলায়ন করে।
আজান দেওয়া : আগুনের আক্রমণ যদি বেড়ে যায় তবে উচ্চস্বরে আগুন নেভানোর নিয়তে আজান দিলেও আল্লাহর রহমতে আগুন নিভে যায়।
পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত পড়লে আগুনের কার্যক্ষমতা নিস্তেজ হয়ে যায় এবং আগুন নেভাতে সহজ হয়। যে দোয়ায় হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে আগুন স্পর্শ করেনি। আর তা হলো ‘ইয়া নারু কুনি বারদাও ওয়া সালামান আলা ইবরাহিম।’ অর্থ : হে আগুন! তুমি ইবরাহিমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।