আল্লাহ তাআলা সব মানুষকে বিভিন্ন পরিচয়ে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ পৃথিবীতে বসবাস করতে বিচিত্র সম্পর্ক ও নানা পরিচয়ে শ্রেণিবদ্ধ হয়ে থাকে। বংশ, বর্ণ, এলাকা, পেশা, ভাষা, রাজনীতি, বিশ্বাস ও আদর্শসহ অনেক প্রকারে মানুষ শ্রেণিবদ্ধ রয়েছে। এসব সম্পর্কের ভিত্তিতে মানুষ একত্র হয় এবং এর ভিত্তিতেই কখনো আবার পরস্পর আলাদা হয়।
তবে এসব সম্পর্কের মধ্য থেকে মৌলিক সম্পর্ক কোনটি? এবং একাধিক সম্পর্কের মধ্যে সংঘর্ষ হলে কোনটিকে প্রাধান্য দিতে হবে, কোরআন-হাদিসের আলোকে এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা আলোচনা করব।
মানবজাতির পারস্পরিক সম্পর্কের মূলভিত্তি ঈমান
প্রয়োজনের তাগিদে মানবজাতির শ্রেণিবিন্যাস গ্রহণযোগ্য ও অনুমোদিত। শরিয়তের সীমায় এসব সম্পর্কের ভিত্তিতে কোনো কাজ সম্পাদন করাও নিষেধ নয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের একজন নারী ও একজন পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি এবং বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পারো।’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ১৩)
তবে যিনি মানুষকে সৃজন করেছেন এ বিষয়ে তিনিই সিদ্ধান্ত দেবেন যে মানুষের মূল শ্রেণিবিন্যাস কিসের ভিত্তিতে হবে। এ জন্যই মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন : ‘তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাদের মধ্যে কতক কাফির এবং কতক মুমিন। আর তোমরা যে আমল করছ আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।’ (সুরা : তাগাবুন, আয়াত : ২)
উক্ত আয়াতে মানবজাতিকে সোজা দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। শুধু বিশ্বাস ও অবিশ্বাসকেই মানুষের বিভক্তির মূল সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই নবীর ঔরসজাত সন্তানকেও ঈমানহীনতার কারণে কোরআনে কারিমে নবীপরিবারের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা হয়নি। যেমনটা দেখা যায় নুহ (আ.)-এর সন্তানের ক্ষেত্রে। (সুরা : হুদ, আয়াত : ৪৫ ও ৪৬)
তদ্রূপ নবীর বাবা ও স্ববংশীয় লোকদের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, শুধু আল্লাহর সঙ্গে কুফরের দরুণ।
যেমনটা দেখা যায় ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পিতার ক্ষেত্রে।
(সুরা : মুমতাহিনা, আয়াত : ৪)
অমুসলিমদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব নয়
অমুসলিমদের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক-সৌহার্দ্য বৈধ, কিন্তু অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব নিষিদ্ধ। এমনকি যদিও তারা স্বগোত্রীয় ও আত্মীয় হয়ে থাকে। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে : ‘হে মুমিনরা, ইহুদি-নাসারাদের তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ কোরো না। তারা একে অপরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে, সে নিশ্চয়ই তাদেরই একজন। নিশ্চয়ই আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে হেদায়েত দেন না।’
(সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৫১)
এ জন্যই মুমিন ও কাফির পরস্পরে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও ইসলামের বিধানমতে তারা পরস্পরে একে-অপরের সম্পদের উত্তরাধিকারী হবে না। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলিম কাফিরের ওয়ারিশ হবে না, আর কোনো কাফির কোনো মুসলিমের ওয়ারিশ হবে না।’ (মুসলিম, হাদিস : ৪০১৮)
অমুসলিমদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ হারাম
অমুসলিমদের সঙ্গেও ইনসাফপূর্ণ আচরণ করা আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সঙ্গে সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে সদা কায়েম হও। কোনো জাতির প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদের ইনসাফ না করতে কোনোভাবে প্ররোচিত না করে। তোমরা ইনসাফ করো, তা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই তোমরা যা করো, আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৮)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘দ্বিনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের বাড়িঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করছেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।’ (সুরা : মুমতাহিনা, আয়াত : ৮)
এ কারণেই হাদিস শরিফে অমুসলিমদের বিরুদ্ধে অন্যায় আচরণ করতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘সাবধান! যে (মুসলিম) কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের ওপর জুলুম করবে বা দুর্ব্যবহার করবে বা তার সামর্থ্যের বাইরে তাকে কোনো কাজ চাপিয়ে দেবে অথবা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার কোনো সম্পদ আত্মসাৎ করবে, কিয়ামতের দিন আমি ওই মুসলিমের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াব।’
(সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩০৫২)