যশোরে এক শিক্ষকের প্রভাবে কওমি মাদ্রাসা বিতর্ক: তিন কন্যার ভবিষ্যৎ অন্ধকার

Share

যশোর অফিস 
 যশোরের কোতয়ালি থানার ফতেপুর ইউনিয়নের দায়তলা পশ্চিমপাড়া এলাকায় এক নাবালিকা ছাত্রীর প্রতি শ্লীলতাহানির অভিযোগে স্থানীয় একটি কওমি মাদ্রাসার মুহতামিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর নতুন করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগের তদন্ত চলমান থাকলেও পরবর্তীতে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবারকে সামাজিকভাবে বয়কট ও তাদের তিন কন্যাকে কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি না করার নির্দেশ পাঠানোয় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে এলাকাবাসীর মধ্যে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, দায়তলা পশ্চিমপাড়ার নূরে মদিনা কওমি মহিলা মাদ্রাসার নূরানী শাখার ছাত্রী মরিয়ম খাতুন (১৫) বেশ কিছুদিন ধরে একই মাদ্রাসার শিক্ষক ও পরিচালক হাফেজ মোঃ জাহাঙ্গীর আলমের (৩৮) অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের শিকার হয়ে আসছিলেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, শিক্ষক জাহাঙ্গীর বিভিন্ন সময় ক্লাস চলাকালে ওই ছাত্রীর সঙ্গে অশোভন আচরণ করতেন, কুপ্রস্তাব দিতেন এবং মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে ফুঁসলানোর চেষ্টা করতেন। এমনকি তিনি রাতের বেলাতেও ফোনে যোগাযোগ করে ডেকে পাঠানোর চেষ্টা করতেন।
বিষয়টি ছাত্রী তার পরিবারকে জানালে, অভিভাবকরা অভিযুক্ত শিক্ষককে সতর্ক করেন। কিন্তু সতর্ক করার পরেও তিনি উল্টো ওই ছাত্রী ও তার পরিবারকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে থাকেন। পরিবারের অভিযোগ অনুযায়ী, সর্বশেষ গত ২ সেপ্টেম্বর দুপুরে মাদ্রাসার গেটের সামনে তিনি ছাত্রীটির পথরোধ করে অশালীন মন্তব্য করেন। প্রতিবাদ করলে জাহাঙ্গীর ছাত্রীর পরিবারকে হুমকি দেন এবং অপহরণের ভয় দেখান। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি, অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেছেন।
পরে ঘটনাটি নিয়ে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে ছাত্রীর পরিবার যশোর কোতয়ালি মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করে। ভুক্তভোগী ছাত্রীর মা নাছিমা বেগম বলেন, আমার মেয়েকে জাহাঙ্গীর হুজুর নানা সময় উত্যক্ত করেছে। আমরা তাকে নিষেধ করার পরও থামেনি, বরং ভয়ভীতি দেখিয়েছে। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা ভীষণ উদ্বিগ্ন।
এ বিষয়ে যশোর কোতয়ালি মডেল থানার কর্তব্যরত কর্মকর্তা বলেন,লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরবর্তীতে ৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে চাঁদপাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ অহিদুজ্জামানসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে এক সালিশ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনার পর পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে আপোষ-মীমাংসা হয়। এ সময় অভিযোগে অভিযুক্ত মাদ্রাসার মুহতামিম হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন বলে জানা যায়। তার চিকিৎসা বাবদ ৩০ হাজার টাকা সহায়তা প্রদান করা হয় এবং উভয়পক্ষ ভবিষ্যতে সুসম্পর্ক বজায় রাখার অঙ্গীকার করে সালিশ শেষ হয়।
তবে এই ঘটনার কিছুদিন পর মাদ্রাসার মুহতামিম জাহাঙ্গীর আলমের পক্ষে খুলনা বিভাগীয় কওমি মাদ্রাসা পরিষদের ফতেপুর ইউনিয়ন শাখার সভাপতি মাওলানা হারুনুর রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক মুফতি জুবায়ের আহমেদের স্বাক্ষরিত একটি পত্র যশোরের বিভিন্ন মহিলা মাদ্রাসায় প্রেরণ করা হয়।
পত্রে ওই পরিবারের তিন কন্যা জান্নাতুল উর্মি (হেফজ বিভাগ), মরিয়ম খাতুন (মিজান জামাত বিভাগ) ও শিশুকন্যা আয়শা খাতুন (দ্বিতীয় শ্রেনীকে) কওমি মাদ্রাসায় ভর্তি করার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
পত্রটি যশোরের একাধিক মহিলা মাদ্রাাসায় পৌঁছালে কর্তৃপক্ষ তিন বোনকেই ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে ওই পরিবার চরম মানসিক ও সামাজিক সংকটে পড়ে। পিতা ইমদাদুল হক বলেন, আমার মেয়েরা ধর্মীয় শিক্ষা লাভে আগ্রহী ছিল। এখন কোনো মাদ্রাায় ভর্তি নিচ্ছে না। আমি অত্যন্ত দুঃখিত ও অসহায় অবস্থায় আছি।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সুশীল সমাজ ও মানবাধিকার কর্মীরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, একটি পরিবারের তিনটি মেয়েকে ধর্মীয় শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা শুধু অমানবিক নয়, মৌলিক অধিকারেরও লঙ্ঘন।
এলাকার সমাজ সচেতন ব্যক্তিরা মনে করেন, ব্যক্তিগত বিরোধের কারণে শিশুদের শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা শিক্ষার আদর্শ ও ইসলামী নীতির পরিপন্থী। তারা দ্রুত প্রশাসনিক তদন্ত এবং সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি জানান।
স্থানীয় অভিভাবকরা বলেন, যদি কোনো অভিযোগ থাকে, তা আইনি প্রক্রিয়ায় নিষ্পত্তি করা উচিত। কিন্তু নির্দোষ শিশুদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
তারা প্রশাসনসহ কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের উচ্চপর্যায়ের নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন, যাতে নির্যাতিত পরিবারের সন্তানরা পুনরায় মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে।
এদিকে, বিষয়টি নিয়ে যশোর জেলার কওমি মাদ্রাসা পরিষদের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। তারা বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন।
সুশীল সমাজের সদস্যরা বলেছেন, ধর্মীয় শিক্ষা কখনো প্রতিহিংসার জায়গা হতে পারে না। ইসলাম ন্যায়বিচার, করুণা ও শিক্ষার সমান সুযোগের শিক্ষা দেয়। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের নিরপেক্ষ তদন্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি।

Read more