যশোরসহ এঅঞ্চলে খাদ্য বিভাগে পরিচিত নাম সালমা চৌধুরী। অধিদপ্তর থেকে শুরু করে যশোর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সংশ্লিষ্ঠ বিভাগে তাকে চেনে না এমন কর্মকর্তা ও কর্মচারী নেই বললেই চলে। সদালাপী ও মিষ্টি ভাষিণী এই কর্মকর্তা উপখাদ্য পরিদর্শক হিসাবে চাকরিতে যোগদান করলেও বর্তমানে তিনি যশোরের শার্শা উপজেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক। চাকরি জীবনে দৃশ্যমান বড় ধরনের অনিয়ম করেও তিনি রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। যেমন আলাউদ্দিন চেরাগের মত খাদ্য বিভাগের একজন নারী কর্মকর্তা হয়েও রাতারাতি হয়েছেন কোটি টাকার মালিক। যতবারই তার বিরুদ্ধে কোন অনিয়ম কিংবা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তিনি ততবারই বিভিন্ন কুট কৌশলী ও কথার মায়াজালে সবাইকে ম্যানেজ করেই আজ এ পর্যন্ত এসেছেন। আর এ কারণে খাদ্য বিভাগে নজির সৃষ্টি করেছেন। এ তথ্য খাদ্য বিভাগের একাধিক সূত্র থেকে পাওয়া গেছে। সর্বশেষ মাগুরা জেলার শালিখার আড়পাড়ার খাদ্যগুদামে বড় ধারণের সরকারি অর্থ লোপাটের ঘটনায় ম্যানেজ ফরমুলায় সালমা চৌধুরী রক্ষা পাওয়ায় তিনি এখন আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে।
একাধিক নির্ভরযোগ সুত্রের দাবি, সালমা চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা। প্রথমে তিনি ঢাকা খাদ্য অধিদপ্তরে চাকরি করেছেন। সে সুবাদে অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যস্থ কর্মকর্তাদের সাথে তার সু- সম্পর্ক রয়েছে। আর এটাই তার বড় পুঁজি। তিনি কাউকে তোয়াক্কা করেন না। চাকরি জীবনে নানা অনিয়ম করলেও অধিদপ্তর থেকে বরাবরই তাকে রক্ষা করা হয়েছে। আর এ সুবাদে তিনি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েও রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। যশোর শহরের বেজপাড়া কবরস্থানের পাশে নির্মাণ করেছেন ৪ তলা বিশিষ্ঠ আড়িশান বাড়ি। হামিদপুরে রয়েছে কোটি টাকার সম্পদ।
সুত্রবলছে, বিভিন্ন তদবীর ও ম্যানেজ ফরমুলায় সালমা চৌধুরী খুবই পারদর্শী।খাদ্য অধিদপ্তর রয়েছে তার অদৃশ্য ক্ষমতা। এজন্য পাহাড় সমান অন্যায় করেও রয়েছেন অধরা। মাগুরার আড়পাড়া সরকারি খাদ্যগুদাম থেকে এক কোটি ১৫ লাখ টাকা মূল্যের ১৯০ মেট্রিকটন চাল ও ২২ হাজার নতুন বড় খালি বস্তা বাইরে বিক্রি করে দেয়ার সাথে জড়িত শালিখা উপজেলার তৎকালীন খাদ্য কর্মকর্তা (বর্তমানে যশোরের শার্শায় কর্মরত) সালমা ম্যানেজ ফর্মুলায় রক্ষা পেয়ে গেছেন। মামলায় বলির পাঠা হয়েছেন গুদাম কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম। অথচ এমিশন থেকে তিনি লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সুত্রের দাবি, ২০২৩ সালের ৬ জানুয়ারি মাগুরার শালিখা উপজেলার আড়পাড়া খাদ্য গুদাম থেকে ১৯০ মেট্রিকটন চাল ও ২২ হাজার নতুন বড় খালি বস্তা আত্মসাতের বিষয়টি ফাঁস হয়। ওইসময় যার দাম ছিল এক কোটি ১৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ওই ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন আলোচিত খাদ্য কর্মকর্তা সালমা চৌধুরী। ওই সময় মাগুরা-২ আসনের এমপি বিরেন শিকদারের ভাই বিমল শিকদারের সাথে যোগসাজস করেন সালমা চৌধুরী। রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় স্থানীয় খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী হাজী সবুর ,উপখাদ্য পরিদর্শক আশা লতা ও নিরাপত্তা প্রহরী সুভাষ চন্দ্র সরকারে মাধ্যমে সালমা চৌধুরী একটি সিন্ডিকেট তৈরী করেন। যার নেতৃত্ব দেন তিনি নিজেই। ওই সিন্ডিকেটর মাধ্যমে গুদাম লোপট করেই তিনি নিরাপত্ত প্রহরী সুভাষ চন্দ্রকে বাঁচাতে দ্রুত বদলী করে দেন। ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে বেকায় পড়ে তিনি অধিদপ্তর থেকে দ্রুত বদলীর অর্ডার করিয়ে যশোরের শার্শায় চলে যান। খাদ্য কর্মকর্তারা বলছেন,খাদ্য গুদামের মূল দায় দায়িত্ব ওসি এলএসডির (গুদাম কর্মকর্তা)। তিনি সবকিছু ঠিকঠাক রাখবেন। এর পরের দায়িত্ব উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার। প্রতি ১৫ দিন পরপর উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তাকে গুদামের স্টক পরিদর্শন করে রেজিস্ট্রার খাতায় লিপিবদ্ধ করতে হয়। যাতে করে গুদাম কর্মকর্তা কোনোভাবেই চালসহ অন্যান্য জিনিসপত্র এদিক-ওদিক করতে না পারে। অথচ এর কোনোটাই করেননি উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা সালমা চৌধুরী।
এমনকি বড় ধারনের এই অনিয়ম ধামাচাপা দিতে গিয়ে সালমা চৌধুরী নানা ছলচুরির আশ্রয় নেন। এ ঘটনায় খাদ্য অধিপ্তর থেকে দুটো তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তাদের ম্যানেজ করে ফেলেন সালমা চৌধুরী। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনের থেকেও তদন্ত করা হলেও সেই রিপোর্টের সাথে খাদ্য অধিদপ্তরের রিপোর্টের হুবহু মিল রয়েছে। কোন তদন্ত রিপোর্টে সালমা চৌধুরীর সংশ্লিষ্ঠতা নেই বলে একাধিক সুত্রে জানা গেছে। নির্ভরযোগ্য একটি সুত্রে জানা গেছে, খাদ্য অধিদপ্তরের শুনানিতে ডাকা হলে সালমা চৌধুরী দুটি হাতে ক্রাচ লাঠি নিয়ে তার উপর ভর করে অফিসে হাজির হন। এ দেখে হতভম্ব হয়ে যান তদন্ত কর্মকর্তারা। সালমা চৌধুরী মায়া কান্না করে তাদের জানান, দীর্ঘদিন যাবত পায়ে সমস্যার কারণে তিনি চলাফেরা করতে পারেন না। তারপরেও তাকে নানাভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে। তিনি আগের থেকেই গুদামের খাটতির ব্যাপারে আড়পাড়া গুদামের ওসিএলএসডিকে জানালে তাকে লোহার রড দিয়ে মারতে গেছেন ওসিএলডি। ওই সময় কান্নাও করে ফেলেন সালমা চৌধুরী। ফলে তদন্তের দায়িক্তে থাকা কর্তকর্তারা ওই ঘটনা শুনে তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন। ওই ঘটনায় দোষী করা হয় এক মাত্র গুদাম কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামকে। সুত্র বলছে, শুরু থেকেই আড়পাড়া গুদামে ১৮টি খামালের স্থলে ১৬ টি খামাল থাকলেও তদন্ত কমিটি সালমা চৌধুরীকে রক্ষা করতে তা এড়িয়ে গেছেন। তদন্ত কমিটি গুদামের চাল পরিমাপ করে ওজন কমের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু শুরু থেকেই গুদামে দুটি খামাল ছিলই না এটা কোথাও উল্লেখ করেনি। আর এই ফরমুলায় সালমাকে রক্ষা করা হয়েছে। একই ভাবে মায়া কান্না করে সালমা চৌধুরী সমস্ত জায়গা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন বলে একাধিক সুত্রে জানা গেছে।
খাদ্য বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাগুরার আড়পাড়া সরকারি খাদ্যগুদাম লোপাটের ঘটনার পুনঃতদন্ত হওয়া দরকার। পুনঃতদন্ত হলে সালমা চৌধুরী এবং জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কোনোভাবেই পার পাবেন না।
এ ব্যাপারে জানতে সালমা চৌধুরীর মোবাইল ফোনে কয়েক দফা কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। এজন্য তার বক্তব্য দেয়া সম্ভব হয়নি।