নড়াইল প্রতিনিধি : নূর মোহাম্মদ শেখ। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধি দেওয়া হয়েছে, নূর মোহাম্মদ তাদের অন্যতম।
রবিবার সেই বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্মদিন। ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নড়াইল সদর উপজেলার চন্ডিবরপুর ইউনিয়নের মহিষখোলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নূর মোহাম্মদ। তাঁর বাবা মোহাম্মদ আমানত শেখ ও মা জেন্নাতুন্নেছা, মতান্তরে জেন্নাতা খানম।
নূর মোহাম্মদের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নূর মোহাম্মদ ট্রাস্ট ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নূর মোহাম্মদ নগরে রবিবার সকাল ৮টায় কোরআনখানি, শোভাযাত্রা, স্মৃতিস্তম্ভে গার্ড অব অনার প্রদান, পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিল, রচনা প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
এছাড়া বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের স্মৃতি সংরক্ষণে তার বসতভিটায় রেস্টহাউজ বা বিশ্রামাগার নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান।
বাল্যকালেই বাবা-মাকে হারান নূর মোহাম্মদ। ফলে শৈশবেই ডানপিটে হয়ে পড়েন। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সপ্তম শ্রেণির পর আর পড়াশোনা করেননি। কৈশোরে নাটক থিয়েটার খুব পছন্দ করতেন নূর মোহাম্মদ।
১৯৫২ সালে নিজ গ্রামের মেয়ে তোতাল বিবিকে বিয়ে করেন। তখন নূর মোহাম্মদের বয়স মাত্র ১৬ বছর এবং স্ত্রী তোতাল বিবির বয়স মাত্র ১২ বছর। তিনি দুই সন্তানের বাবা ছিলেন। ১৯৫৪ সালের শেষ দিকে তার প্রথম সন্তান হাসিনা খাতুন এবং ১৯৬৪ সালের ১৫ নভেম্বর দ্বিতীয় সন্তান শেখ মো. গোলাম মোস্তফা জন্মগ্রহণ করেন।
যুবক নূর মোহাম্মদ ১৯৫৯ সালের ১৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বা ইপিআর-এ যোগদান করেন। দীর্ঘদিন দিনাজপুর সীমান্তে চাকরি করার পর ১৯৭০ সালের ১০ জুলাই তাঁকে দিনাজপুর থেকে যশোর সেক্টরে বদলি করা হয়। এরপর তিনি ল্যান্স নায়েক পদে পদোন্নতি পান।
১৯৭১ সালে যশোর অঞ্চল নিয়ে গঠিত ৮নং সেক্টরে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন নূর মোহাম্মদ। যুদ্ধ চলাকালীন যশোরের শার্শা থানার কাশিপুর সীমান্তের বয়রা অঞ্চলে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদার নেতৃত্বে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন তিনি।
যুদ্ধ করতে গিয়েই ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর যশোর জেলার গোয়ালহাটি গ্রামে শাহাদাতবরণ করেন নূর মোহাম্মদ। সেদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ ও দলীয় সঙ্গীদের জীবন ও অস্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হন তিনি। যশোরের শার্শা উপজেলার কাশিপুরে তাকে সমাহিত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ পরবর্তীতে নূর মোহাম্মদকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। মৃত্যুর ২৭ বছর পর ২০০৮ সালের ১৮ মার্চ তাঁর জন্মস্থান মহিষখোলার নাম পরিবর্তন করে নূর মোহাম্মদ নগর করা হয়।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিরক্ষার্থে নূর মোহাম্মদ নগরে নির্মাণ করা হয়েছে ‘বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর’, স্মৃতিস্তম্ভ এবং স্কুল ও কলেজ। এছাড়া নড়াইল শহরে বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ স্টেডিয়াম এবং নড়াইল ও যশোর শহরে সন্তানদের জন্য বাড়ি।
২০১৮ সালের ২১ নভেম্বর নূর মোহাম্মদ শেখের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা বার্ধক্যজনিত কারণে ৮০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদের তিন মেয়ে ও এক ছেলে বর্তমানে নড়াইল এবং যশোর শহরে বসবাস করেন।