ঢাকা অফিস: ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের পর বাড়ানো হয়েছে শিল্প-কারখানায় ও বিদ্যুৎ খাতে সরবরাহ করা প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির ফলে এখন শিল্প খাতের উৎপাদন খরচও বেড়ে যাবে। ব্যবসায়ীরা এই বাড়তি খরচ ভোক্তাদের কাছ থেকেই আদায় করবেন। ফলে সরাসরি ভোক্তার গায়ে ভর্তুকির প্রভাব না পড়লেও পরোক্ষভাবে পড়বে।
গত বুধবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন মূল্য কার্যকর হবে। সরকারের নির্বাহী আদেশে গ্যাসের দাম খাত ভেদে ১৪ থেকে ১৭৮ শতাংশ বাড়ানো হয়। এতে বলা হয়, ভর্তুকি সমন্বয় ও গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতে ১৭৯ শতাংশ, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৮৮ শতাংশ, বড় শিল্পে ১৫০ শতাংশ, মাঝারি শিল্পে ১৫০ শতাংশ ও ক্ষুদ্র শিল্পে ১৭৮ শতাংশ এবং বাণিজ্যিক খাতে ১৪ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে।
গ্যসের নতুন মূল্য বৃদ্ধিকে দেশের ইতিহাসে রেকর্ড দাম বৃদ্ধি বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, সরকার ভর্তুকি কমাতে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার চাপ পড়বে ভোক্তার ওপর। এমনিতেই জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় অন্যান্য খরচও বেড়েছে। এ অবস্থায় গ্যাসের দাম বৃদ্ধি শিল্প খাতের জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘার মতো হয়েছে। এতে একদিকে পণ্য উৎপাদন খরচ বেড়ে ব্যবসার প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমবে, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি বেড়ে সাধারণ মানুষের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত শিল্পোৎপাদন, নির্মাণ কার্যক্রম, ভোগ্যপণ্যসহ সামগ্রিক জীবনযাত্রায় ব্যয় বাড়িয়ে দেবে। কারণ দিনশেষে বাড়তি উৎপাদন খরচ ভোক্তা থেকেই আদায় করবেন ব্যবসায়ীরা।
সরকারের ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, প্রতি মাসেই খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির যুক্তি দেখিয়ে গত বছর আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করে সরকার। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ৮০ টাকা বাড়িয়ে ১১৪, পেট্রোল ৮৬ থেকে ১৩০ এবং অকটেনের দাম ৮৯ থেকে বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কয়েক দিনের মাথায় লিটারপ্রতি দাম ৫ টাকা কমিয়ে যথাক্রমে ১০৯, ১২৫ ও ১৩০ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। পরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেনি। গত ১২ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ বিভাগ বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করে চলতি জানুয়ারি মাস থেকেই কার্যকর হয়।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। অনেক বিকল্প পথ থাকলেও সরকার সেদিকে যায়নি। সরকার বলছেন বিপুল পরিমাণ আর্থিক ঘাটতি মেটাতে দাম বাড়ানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকার দেশের গ্যাস উত্তোলন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারতো। বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে কিছু প্রতিষ্ঠানকে যে ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছে তা পদ্মা সেতুর ব্যয়ের দ্বিগুণ। গ্যাসের অনুসন্ধান না করে বেশি দামে এলএনজি আমদানিতে করছে। কিন্তু এলএনজির দাম রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ না থামলে বাড়তে থাকবে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানায়, গত বছর প্রতিদিন ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানির কথা জানিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় পেট্রোবাংলা। বিইআরসি গত জুনে ওই প্রস্তাবের ভিত্তিতে গ্যাসের দাম প্রায় ২৩ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। তখন প্রতিদিনের জন্য আমদানি ধরা হয়েছিল দিনে ৬৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। এখন দিনে এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে গড়ে ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট।
এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, জ্বালানি খাতে দুর্নীতি কমানো যায় তাহলে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে না। সরকার গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি সমন্বয় করতে চাইছে। এজন্য বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা দরকার। এ অবস্থায় চড়া দামে বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা অসম্ভব।
তিনি বলেন, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো এখন মুনাফায় রয়েছে। এখন দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই। করোনায় এমনিতেই মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ। তারা এ মূল্যবৃদ্ধির চাপ নেওয়ার অবস্থায় নেই।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতকে বাণিজ্যিকীকরণ মুক্ত করতে হবে। নিজস্ব জ্বালানি সম্পদের উন্নয়ন অব্যাহত রাখাসহ সাশ্রয়ী হতে হবে। লুন্ঠন জাতীয় সব ব্যয় বন্ধ করতে পারলে সংকট কমবে। নাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।’
এ বিষয়ে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, বিদ্যুতের পর গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি। এখন দেশের অর্থনীতির যা অবস্থা তাতে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ার ফলে সব ধরনের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। ফলে পণ্যের দাম বাড়বে। যা বহন করতে হবে ভোক্তাদের।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, গ্যাসের দাম অনেক বাড়ানো হয়েছে, যা সমন্বয় করা ব্যবসায়ীদের জন্য কঠিন। ডলারের দাম বেশি, ব্যাংক এলসি খুলছে না। কয়েক মাস ধরে গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। এ অবস্থায় বাড়তি খরচের বোঝা শিল্পোৎপাদন ও ব্যবসাকে বাধাগ্রস্ত করবে। তিনি বলেন, দাম বাড়লেও ব্যবসায়ীরা নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিয়ে শঙ্কিত।