মাধঘোপা নিউজ ডেক্স: বিভিন্ন কাজের প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের পাশের দেশ ভারতে পাচার করত একটি চক্র। পাঁচ বছরে এই চক্রটি পাঁচ শতাধিক নারীকে পাচার করেছে। র্যাব বলছে, পতিতাবৃত্তির জন্যই এসব নারীকে পাচার করা হতো। এই পাচারকারী চক্রে প্রায় ৫০ জন জড়িত। পাচার করা নারীদের দুটি ভাগে ভাগ করা হতো। একটি গ্রুপে ছিল মধ্যবিত্তরা, আরেকটিতে ছিল নিম্ন মধ্যবিত্তরা। মধ্যবিত্ত নারীদের ভারত থেকে দুবাইয়ে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হতো। আর নিম্ন মধ্যবিত্ত নারীদের ভারতে উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখানো হতো।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশি তরুণীকে বিবস্ত্র করে কয়েকজন যুবকের যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরালের ঘটনায় আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্রের অন্যতম মূল হোতা আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফিসহ চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। বাকি তিনজন তারা হলেন- রাফির অন্যতম নারী সহযোগী সাহিদা বেগম ম্যাডাম সাহিদা, ইসমাইল সরদার ও মো. আব্দুর রহমান শেখ ওরফে আরমান শেখ।
মঙ্গলবার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এলিট ফোর্সটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ভারতে তরুণীকে নির্যাতনের ঘটনায় তার বাবা রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার আইন ও পর্নোগ্রাফি আইনে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় টিকটিক বাবুসহ অজ্ঞাতনামা আরও চারজনকে আসামি করা হয়। এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সোমবার থেকে মঙ্গলবার র্যাব-৩ এর অভিযানে ঝিনাইদহ, যশোর ও বেনাপোল থেকে নারী পাচার চক্রের মূল হোতা আশরাফুল ইসলাম ওরফে বসসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করতো। দেশি- বিদেশিসহ প্রায় ৫০ জন এই চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে আমরা জানতে পেরেছি।’
যেভাবে তরুণীদের সংগ্রহ করা হতো
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে অনলাইনে একটি গ্রুপ খোলেন ‘টিকটক হৃদয় বাবু’। তিনি বিভিন্ন বয়সী নারী ও তরুণীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। হৃদয় যে গ্রুপ খুলেছিলেন সেখানে তরুণীদের মডেল বানানোসহ বিভিন্ন চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করা হতো। পরে পার্শ্ববর্তী দেশের সুপারমল, সুপারশপ ও বিউটি পার্লারে চাকরি দেয়ার কথা বলে দেশ থেকে তরুণী ও নারীদের ‘বস রাফির’ সহযোগিতায় বিদেশে পাচার করত। এরপর তাদেরকে একটি সেফ হাউজে নেয়া হতো।
বৈধ বা অবৈধ উভয় পথে সীমান্ত অতিক্রম করানো হতো জানিয়ে খন্দকার মঈন বলেন, ‘প্রথমত ভিকটিমদের সীমান্তবর্তী জেলা- যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ নিয়ে আসত। এরপর ভিকটিমদের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন সেফ হাউজে নিয়ে অবস্থান করানো হতো। সেখান থেকে সুবিধাজনক সময়ে লাইনম্যানের মাধ্যমে অরক্ষিত এলাকা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করানো হতো। এরপর পার্শ্ববর্তী দেশের এজেন্টরা তাদেরকে গ্রহণ করে সীমান্ত নিকটবর্তী সেফ হাউজে রাখত। পরে তাদেরকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে এবং জোর করে মাদক সেবন করতে বাধ্য করত। মাদক সেবনের পর তাদের জোরপূর্বক যৌন ভিডিও ধারণ করত, যাতে পরবর্তী সময়ে এদের ‘ব্ল্যাকমেইল’ করা যায়।’
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, সুবিধাজনক সময়ে এসব নারীকে কলকাতার সেফ হাউজে পাঠানো হতো। পরের ধাপে কলকাতা থেকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের বেঙ্গালুরু পাঠানো হতো। বেঙ্গালুরু পৌঁছানোর পর গ্রেপ্তার ‘বস রাফি’ তাদের গ্রহণ করে বিভিন্ন সেফ হাউজে অবস্থান করাতেন। পরে ব্ল্যাকমেইল ও মাদকাসক্তে অভ্যস্থকরণ ও অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে পতিতাবৃত্তি পেশায় বাধ্য করতেন। সেফ হাউজগুলো থেকে তাদের ১০ থেকে ১৫ দিনের জন্য বিভিন্ন খদ্দেরের কাছে সরবরাহ করা হতো। এক্ষেত্রে পরিবহন ও খদ্দেরের নির্ধারিত স্থানে অবস্থানের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা নেয়া হতো। পার্শ্ববর্তী দেশের এজেন্ট তাকে খদ্দেরপ্রতি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা কমিশন দিত। ক্ষেত্রবিশেষে নারীদের অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করা হতো।
গ্রেপ্তার রাফি যা জানিয়েছেন
ভারতে নির্যাতিত ওই তরুণী দুজন বাংলাদেশি নারীকে দেশে পালিয়ে আসতে সহযোগিতা করেন। এই কারণে তাকে নির্মমভাবে অত্যাচার করা হয়। তাকে বলা হয়, সে যদি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে ধারণ করা ভিডিওটি স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
গত বছরের অক্টোবর মাসে নির্যাতিত তরুণীকে ভারতে পাঠানো হয় বলে জানিয়েছে র্যাব।
কে এই সাহিদা?
বস রাফির অন্যতম নারী সহযোগী ম্যাডাম সাহিদা। তার একাধিক বিয়ে হয়েছিল। ম্যাডাম সাহিদা ও তার দুই মেয়ে সোনিয়া ও তানিয়া পাচার চক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাবে জড়িত। সোনিয়া ও তানিয়া বর্তমানে বেঙ্গালুরে অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছেন গ্রেপ্তার সাহিদা। ভাইরাল ভিডিওতে তরুণীকে নির্যাতনে সহযোগিতা করেন তানিয়া।
জানা গেছে, সাহিদা দেশে একটি সেফ হাউস পরিচালনা করতেন। সেখানে নারীদের অবৈধ কার্যক্রম চলত। ১০ বছর ধরে সাহিদা এই অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত।
দালালরা সীমান্ত কীভাবে ম্যানেজ করত জানতে চাইলে র্যাব জানায়, দালালরা যশোরের সীমান্ত এলাকায় বিভিন্নভাবে সীমান্ত ম্যানেজ করত। তারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকত। সীমান্তে যখন নিরাপত্তাব্যবস্থা শিথিল থাকত তখন পাচারকারীরা নারীদের পাচার করত। অনেক সময় কাঁটাতারের ব্যারা কেটে ভারতে পাচার করত।
কত টাকার বিনিময়ে ভারতে নারীদের পাচার করা হতো, এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র্যাব কর্মকর্তা আল মঈন বলেন, ‘মাত্র ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায় ভারতের নারীদের পাচার করা হতো।’
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, পাচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশি নারীদের দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। একটি গ্রুপে মধ্যবিত্তদের আরেকটি ছিল নিম্ন মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্ত নারীদের ভারত থেকে দুবাইয়ে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হতো। আর নিম্ন মধ্যবিত্ত নারীদের ভারতে উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করত।