মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে নৃশংস ভাবে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করলো ছেলে

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি: মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে নৃশংসভাবে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যার পর ডাকাতির নাটক সাজিয়েছিল তারই ছেলে এইচ এম মাসুদ। এই ঘটনার তদন্তে নেমে এমন তথ্য পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সংস্থাটি ঘটনায় জড়িত ঘাতক ছেলেকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে। তবে ছেলে ছাড়াও হত্যায় সরাসরি জড়িত রুবেল নামে এক অটোচালককে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই।

রবিবার ধানমন্ডি পিবিআই সদরদপ্তরে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান নারায়ণগঞ্জ পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম।
পিবিআই বলছে, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ধর্মগঞ্জ মাওলা বাজার এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিমের বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধা হালিমকে নৃশংসভাবে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ হত্যা করে ডাকাত সদস্যরা। পহেলা ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রেক্ষিতে নিহতের মেয়ে জামাই থানায় এমনটা উল্লেখ করে মামলা করেন। ডাকাত সদস্যরা বাসায় থাকা নগদ ৩২ লাখ টাকা ও সিসিটিভি ডিভিআর নিয়ে যায়।
তবে পিবিআই এর তদন্তে বেড়িয়ে আসে আসল রহস্য। মামলার তদন্তে নেমে সম্পত্তির লোভে পুত্রের পরিকল্পনায় পিতা হত্যার এক লোমোর্ষক ঘটনার সত্যতা খুঁজে পায়।
হত্যায় জড়িত ছেলের সহযোগী রুবেলকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই। এ সময় রুবেলের দেখানো জায়গা থেকে চুক্তির সাড়ে চার লাখ টাকা, সিসিটিভি ক্যামেরার ডিভিআর ও পাটের রশি উদ্ধার করা হয়।
এসপি মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিমের হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই পিবিআই নারায়ণগঞ্জ জেলা টিম মামলার মূল রহস্য উদঘাটন ও জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তারে তদন্ত শুরু করে। তদন্তে নেমে জানা যায়, পরিবারের পূর্ব পরিচিত অটো চালক মো. রুবেল। সে এই পরিবারের বাজার করাসহ বিভিন্ন কাজ করত। কিন্তু ঘটনার পরে তাকে এলাকায় দেখা যাচ্ছিল না। তথ্য প্রযুক্তি সহায়তায় তদন্তকারীরা নিশ্চিত হন, ঘটনার সময়ে ভুক্তভোগীর বাড়ির আশপাশে অবস্থান করছিলেন রুবেল। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় বোনের বাসায় আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় রুবেলকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গ্রেপ্তার রুবেল ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে আদালতে জবানবন্দি দেন।
রুবেলের জবানবন্দিতে উঠে আসে হত্যার আসল রহস্য। যেভাবে হত্যা:
নিহতের পরিবারের বিভিন্ন কাজকর্ম করে বিশ্বস্ততা অর্জন করেন রুবেল। নিহতের ছেলে এইচ এম মাসুদ সম্পত্তি ভাগাভাগি এবং বাসায় থাকা টাকা আত্মসাত করার পরিকল্পনা করে। আর এ জন্য পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে রুবেলের সঙ্গে বাবাকে হত্যার চুক্তি করে। ঘটনার দিন ৩১ জানুয়ারি রাত ১০টার দিকে রুবেলকে ফোন করে দ্রুত মাসুদের বাড়িতে আসতে বলা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আগে থেকে খুলে রাখা হয় কলাপসিবল গেট ও রুমের দরজা। এরপর রুবেল সোজা মাসুদের রুমে প্রবেশ করে। রাত ১১টার দিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিম ঘুমিয়ে পড়লে রুবেল ও মাসুদ তার রুমে প্রবেশ করেন। প্রথমে নিহতের ছেলে মাসুদ তার বাবার হাত পা চেপে ধরে, আর রুবেল গলা চেপে ধরে। এ সময় চিৎকার দিলে রুবেল বালিশ দিয়ে মুখ চেপে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে।
মাসুদ বাবার মৃত্যু নিশ্চিত করতে ঘরে থাকা ডিজিটাল ব্লাড প্রেসার দিয়ে মেপে মৃত্যু নিশ্চিত হন। পরিকল্পনা অনুযায়ী রুবেলকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হয় এবং বাসার সিসিটিভি ক্যামেরার ডিবিআর বক্স বাহিরে ফেলে দিতে বলা হয়। পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হত্যাকান্ডের ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য ডাকাতির নাটক সাজাতে মাসুদকে পাটের রশি দিয়ে হাত—পা বেঁধে এবং গামছা দ্বারা মুখ বেঁধে ফ্লোরে ফেলে রাখতে বলা হয়। এরপর রুবেল তা করে টাকা আর ডিবিআর বক্স নিয়ে বাড়ির পেছন দিয়ে পালিয়ে যায়। এসময় রুবেল ডিবিআর বক্সটি নিহতের বাড়ির পিছনে ময়লার স্তুপের নিচে লুকিয়ে রেখে যায়।
ঘটনার পরদিন নিহতের জানাযা এবং লাশ দাফন শেষে মাসুদের পরামর্শে রুবেলকে আত্মগোপনে যেতে বলা হয়। নারায়ণগঞ্জ থেকে পালিয়ে যাত্রাবাড়িতে বোনের বাসায় আত্মগোপনে যায়। সেখান থেকে গ্রেপ্তার শেষে রুবেলকে নিয়ে অভিযান চালিয়ে তার বাসা থেকে চার লাখ ৪৩ হাজার টাকা এবং নিহতের বাড়ির বাড়ির পিছনের ময়লার স্তুপ থেকে ডিবিআর উদ্ধার করা হয়।
আলামত হিসেবে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত পাটের রশি, গামছা এবং বালিশ, ডিজিটাল ব্লাড প্রেসার মাপার মেশিন জব্দ করা হয়। এই মামলার অন্যতম আসামি নিহতের ছেলে মাসুদকে গ্রেপ্তারে জন্য অভিযান চলমান রয়েছে।