বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে প্রায় সাড়ে ১০ বিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ যুক্ত করে অর্থনীতিতে নীরবে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। বর্তমানে দেশে মোট বিদ্যুৎ সরবরাহের ৭ থেকে ৮ শতাংশ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন নয়, স্থানীয় মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও পরিবেশ সুরক্ষায়ও ভূমিকা রাখছে প্রকল্পটি।
বাংলাদেশ-ভারত যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এনটিপিসি লিমিটেডের সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বাস্তবায়ন করে।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। দ্বিতীয় ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ২০২৪ সালের মার্চে। বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুটি ইউনিট থেকে পুরো সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরের জুনে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সর্বোচ্চ উৎপাদন অর্জন করেছে ৬৭৬.৭৩ মিলিয়ন ইউনিট।
কেন্দ্রটির ইউনিট-২ থেকে গত ১ জুন সর্বোচ্চ দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন হার ১০০.৩ শতাংশ রেকর্ড করেছে। ইউনিট-১ থেকে গত ১৫ জুন সর্বোচ্চ দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদন হার ১০০.৪৬ শতাংশ রেকর্ড করেছে। ইউনিট-১ থেকে গত এপ্রিলে মাসিক সর্বোচ্চ কেন্দ্রের কার্যক্ষমতার হার ৯৯.৯৬ শতাংশ অর্জন করেছে। গত জুনে সর্বোচ্চ মাসিক কেন্দ্রের কার্যক্ষমতার হার ৯৭.২৮ শতাংশ অর্জন করেছে।
গত এপ্রিল থেকে জুন—এই তিন মাসের (কিউ ৪) সর্বোচ্চ স্টেশন ডিসি ৯২.২ শতাংশ। এই আর্থিক বছরের জন্য স্টেশন ডিসিটি গত ১২ এপ্রিলে সম্পন্ন হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জাতীয় গ্রিডে প্রতিনিয়ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে শিল্পায়নে অবদান রাখছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। দেশের জাতীয় গ্রিডে যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যুৎ যোগ করছে এবং স্থানীয় অর্থনীতিকেও গতিশীল করছে। স্থানীয় যুবকদের কর্মসংস্থানের সুবিধা এবং নারী ও সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট কার্জক্রমও বেশ ভালোভাবে করে যাচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
এ বিষয়ে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) রমানাথ পূজারী বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১০ হাজার ৩৫৯ বিলিয়ন ইউনিটের বেশি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়েছে। আর প্রতি মাসে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রায় দেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ৭ থেকে ৮ শতাংশ সরবরাহ করা হচ্ছে। গত তিন মাসে নিয়মিত কয়লা সরবরাহ থাকায় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছি। আমাদের কাছে যে পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা দেওয়া হচ্ছে, আমরা তা পূরণ করতে পারছি। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬৬০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট থেকে দিনের বেলা ৪০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকে। আর সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত চাহিদা থাকে ৬০০ থেকে ৬৬০ মেগাওয়াট। গত ১ জুন ও ১৫ জুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটই আলাদা আলাদা করে সক্ষমতার শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। ’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক এবং জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অবশ্যই দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ একদিকে আমাদের দেশীয় গ্যাসের মজুদ ও উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমছে, অন্যদিকে বাড়তি এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানিও করতে পারছি না। এই অবস্থায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বাড়ানোর কোনো রকম চিন্তা আমরা করতে পারছি না। তাই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আমাদের জন্য খুবই জরুরি। সার্বিক দিক বিবেচনা করে দেশের সব কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এসব কেন্দ্র দেশে অবদান রাখছে। ’
বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্ন কয়লা সরবরাহ
কয়লা সরবরাহের বিষয়ে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, আমাদের কেন্দ্রের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বকেয়া আটকে থাকার পরও নিরবচ্ছিন্নভাবে কয়লা সরবরাহ দিয়ে গেছে। যার কারণে আমরা পুরো সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ধরে রাখতে পেরেছিলাম। এখনো আমাদের পর্যাপ্ত কয়লার মজুদ রয়েছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক রমানাথ পূজারী বলেন, জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে না। তবে বৃষ্টির কারণে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকায় অনেক সময় একটি কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। আগামীতে ঝুঁকি এড়াতে কয়লার মজুদ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে মজুদ সক্ষমতা বাড়িয়ে সব সময় চার থেকে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন কয়লা মজুদ রাখা হবে বলেও তিনি জানান।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভেতরে হচ্ছে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বিভিন্ন ভবনের ছাদ ও খালি জায়গায় প্রাথমিকভাবে ১০ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। জানা গেছে, টাউনশিপ ভবনের ছাদ ও লেবার কলোনি, জেটি ও টাউনশিপে খালি জায়গায় সোলার প্যানেল বসানোর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এরই মধ্যে ইন-হাউস প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। বিস্তারিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষার জন্য পরামর্শদাতা নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। এখান থেকে উৎপাদিত সৌরবিদ্যুৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ খরচ কমাবে। একই সঙ্গে চাহিদার বাড়তি সৌরবিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলেও প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে রমানাথ পূজারী বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভেতরে ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌরবিদ্যুতের কাজ প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে। আশা করছি বছর খানেকের মধ্যে এটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে উৎপাদনে যেতে পারবে। এ জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছ থেকে আমাদের অনুমতি নিতে হবে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে চলে যাবে। ভবিষ্যতে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে আরও ৪০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে বলেও তিনি জানান।