মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ ব্যাংক খাত, অর্থনীতিতে অশনিসংকেত

Share

দেশের ব্যাংক খাত অনেকদিন ধরেই ধুঁকছে। চলছে তারল্য সংকট। আছে ঋণ কেলেঙ্কারি, অর্থ লুট ও মানি লন্ডারিংয়ের মতো ঘটনা। অনেক ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী আমানতকারীকে টাকা দিতে পারছে না। এতে বাড়ছে আস্থার সংকট। ব্যাংকগুলোর সুদ থেকে নিট আয়ও কমে আসছে। বিপরীতে রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতি। সামগ্রিকভাবে যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংক খাতের মূলধন সংরক্ষণে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের ব্যাংক খাতের মূলধন সংরক্ষণের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমনকি সেটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে তলানিতে নেমে এসেছে। অস্বাভাবিক হারে খেলাপি ঋণ বাড়ার ফলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

 

বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এখন অভূতপূর্ব সংকটে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে শক্তিশালী মূলধন সংরক্ষণে সক্ষম হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়েছে।

২০২৪ সালে দেশের ব্যাংক খাতে মূলধন পর্যাপ্ততা নাটকীয়ভাবে কমে মাত্র ৩ দশমিক ০৮ শতাংশে নেমে এসেছে। যা আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে ছিল ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ

২০২৪ সালে দেশের ব্যাংক খাতে মূলধন পর্যাপ্ততা নাটকীয়ভাবে কমে মাত্র ৩ দশমিক ০৮ শতাংশে নেমে এসেছে। যা আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে ছিল ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এ হিসাবে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতের মূলধন পর্যাপ্ততা কমেছে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

এ অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশের মধ্যে মূলধন সংরক্ষণে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ। মূলধন পর্যাপ্ততা হারের এই অস্বাভাবিক অবনমনকে দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন ২০২৪’-এর তথ্য অনুযায়ী—ব্যাংক খাতের মূলধন সংরক্ষণে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান। ২০২৪ সালে দেশটির ব্যাংক খাত মূলধন সংরক্ষণ করেছে ২০ দশমিক ৬ শতাংশ। এর আগের বছর ২০২৩ সালে দেশটির ব্যাংক খাতের মূলধন পর্যাপ্ততা ছিল ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ। যা ২০২২ সালে ছিল ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ।

ব্যাংকগুলোর মূলধন কমে গেলে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়ে যায়। এখন অনেক ব্যাংক বিনিয়োগ বা পুনর্বিনিয়োগ করতে পারছে না। কারণ, তাদের অধিকাংশ আয় কমে গেছে।- ডেপুটি গভর্নর

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে শ্রীলঙ্কার ব্যাংক খাত ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ, ভারতের ব্যাংক খাত ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করেছে। যেখানে বাংলাদেশ মূলধন সংরক্ষণ করেছে মাত্র ৩ দশমিক ০৮ শতাংশ। যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন এবং প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।

কোনো একটি দেশের ব্যাংক খাতকে কমপক্ষে ১০ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। সেক্ষেত্রে ১২ শতাংশ মূলধন থাকলে সে দেশের ব্যাংক খাতকে ঝুঁকিমুক্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

মূলত, ঋণখেলাপির কারণে দেশের ব্যাংক খাতে এ ভঙ্গুর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যার মধ্যে বিগত সরকারের অনেকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নেওয়ার পর তা পরিশোধ করেননি। কিন্তু তাদের ঋণ বিশেষ ছাড়ে নবায়ন করা হয়েছিল। ফলে কিস্তি পরিশোধ না হলেও ব্যাংক তা খেলাপি না দেখিয়ে নিয়মিত হিসাবে রেখেছিল। কিন্তু সরকার পতনের পর এসব ঋণকে খেলাপি হিসাবে দেখানো হয়।

বিগত সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতের অনিয়ম-লুটপাট ছিল লাগামহীন। ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বিতরণ করা হলেও অধিকাংশ ঋণগ্রহীতা তা ফেরত দেয়নি। আবার আমদানি-রপ্তানির আড়ালে কাড়ি কাড়ি টাকা পাচার হয়েছে বিদেশে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন (ডেপুটি গভর্নর) কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর মূলধন কমে গেলে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়ে যায়। এখন অনেক ব্যাংক বিনিয়োগ বা পুনর্বিনিয়োগ করতে পারছে না। কারণ, তাদের অধিকাংশ আয় কমে গেছে।’

এদিকে, ধারাবাহিক নীতিগত সংস্কার, সুশৃঙ্খল তদারকি ও শক্তিশালী প্রভিশন ব্যবস্থার ফলে পাকিস্তান মূলধন সংরক্ষণের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের পর ঘুরে দাঁড়ানো শ্রীলঙ্কার ব্যাংক খাতে মূলধন পর্যাপ্ততা বেড়েছে। দেশটির ব্যাংক খাতকে আন্তর্জাতিক সহায়তা, কঠোর পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ও দায়বদ্ধ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে টেনে তোলা হয়েছে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর একত্রীকরণ, খেলাপি ঋণ হ্রাস ও কঠোর নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার কারণে ভারতের ব্যাংক খাতে মূলধন সংরক্ষণ স্থিতিশীল অবস্থানে রয়েছে।

 

খেলাপি ঋণ কঠোরভাবে আদায় ও শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। মূলধন পুনঃসংগঠন ও প্রভিশনিং বাধ্যতামূলক করতে হবে। দুর্নীতি দমন ও অর্থপাচার বন্ধে স্বাধীন আর্থিক গোয়েন্দা কার্যক্রম নিতে হবে।- এম. হেলাল আহমেদ জনি

বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টো। ২০২১ সালে মূলধন পর্যাপ্ততা ছিল ১১ দশমিক ০৮ শতাংশ, ২০২২ সালে ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২৩ সালে ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ২০২৪ সালে তা হঠাৎ ভেঙে পড়ে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ০৮ শতাংশে নেমে আসে। অর্থাৎ, এক বছরে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ কমে গেছে।

কেন ভেঙে পড়লো মূলধন পর্যাপ্ততা—বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ও সহকারী মুখপাত্র শাহরিয়ার সিদ্দিকী প্রতিবেদনে স্বীকার করেছেন, ‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় আমাদের মূলধন পর্যাপ্ততা অনেক কম। এর প্রধান কারণ অতিরিক্ত খেলাপি ঋণ। এসব ঋণের বিপরীতে অনেক ব্যাংক পর্যাপ্ত প্রভিশন রাখতে পারছে না। এজন্য মূলধন থেকে অর্থ বাদ দিতে হয়েছে।’

এর প্রভাবে আর্থিক খাতে অচলাবস্থা তৈরি হচ্ছে। ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ বা বিনিয়োগ দিতে পারছে না। আস্থার সংকট বাড়ছে। আমানতকারীরা ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়। পাশাপাশি ব্যবসায় বিনিয়োগ কমছে, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়ছে। মূলধন পর্যাপ্ততা কমায় আন্তর্জাতিকভাবেও অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে বাংলাদেশি ব্যাংকগুলোকে ‘অনির্ভরযোগ্য’ মনে করছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।

ব্যাংক খাতের ভঙ্গুর এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কী? সমাধানইবা আসবে কোন উপায়ে? অর্থনীতিবিদেরা বলছেন—দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো সংকট কাটিয়ে স্থিতিশীল অবস্থানে পৌঁছে গেছে। তবে রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি ও খেলাপি ঋণের কারণে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত গভীরতম সংকটে পতিত হয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি দুর্নীতির লাগাম টানা ও ঋণখেলাপি দ্রুত কমিয়ে আনতে পারলে অবস্থার উন্নতি সম্ভব।

জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম. হেলাল আহমেদ জনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘খেলাপি ঋণ কঠোরভাবে আদায় ও শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। মূলধন পুনঃসংগঠন ও প্রভিশনিং বাধ্যতামূলক করতে হবে। দুর্নীতি দমন ও অর্থপাচার বন্ধে স্বাধীন আর্থিক গোয়েন্দা কার্যক্রম নিতে হবে। দায়িত্বজ্ঞানহীন পরিচালক ও ঋণগ্রহীতাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।

Read more