রাজীব হোসেন,যশোর প্রতিনিধি : বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের গলিতে লুকিয়ে থাকে হাজার হাজার মানুষের গল্প-গল্প যা জানার কেউ নেই, শোনার কেউ নেই। ঝিনাইদহ জেলার পাগলা কানাই গ্রামের মোঃ সাইফুর রহমান, যার বেশি পরিচিত নাম ‘রিপন হোসেন’, সেই গল্পগুলো তুলে ধরেছেন। ৪৪ বছর বয়সী এই মানুষটি ফেসবুকের মাধ্যমে ‘স্বপ্ন তেইশ’ নামে একটি পেজ পরিচালনা করেন, যেখানে তিনি গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবন, সংগ্রাম ও আবেগের গল্প নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরেন।
রিপনের জীবন এক সংগ্রামের প্রতীক। ছোটবেলা থেকে নানা ত্যাগ আর কষ্টের মধ্য দিয়ে তিনি নিজের জীবন গড়ে তুলেছেন। তার স্বপ্ন ছিল বড়, কিন্তু বাস্তবতার বাধা তাকে এক সময় ইজিবাইক চালাতে বাধ্য করেছে। তবে তিনি শুধু চালক নন, ছিলেন ইজিবাইক মিস্ত্রি এবং মানবিক কাজে নিবেদিত।
রিপনের জীবনের শুরুটা সহজ ছিল না। দরিদ্র ও ছোট পরিবারের ছেলে হিসাবে তার পথ কঠিন ছিল। জীবনের নিত্যদিনের লড়াই ছিল বেঁচে থাকা। ইজিবাইক চালিয়ে এবং মিস্ত্রির কাজ করে তার সংসার চলে। তবে এখানেই থেমে থাকেনি সে। বিক্রি করা গরুর টাকা দিয়ে আট সপ্তাহ ধরে প্রতি শুক্রবার তিনি দু’শ থেকে আড়াইশো অসহায় মানুষের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতেন। এই কাজটি ছিল তার মানবিকতার এক অপূর্ব নিদর্শন। তাকে শুধু একজন গ্রামীণ মানুষ হিসেবেই নয়, বরং এক মানবতার দূত হিসেবেও দেখা হয়।
রিপনের ফেসবুক পেজ ‘স্বপ্ন তেইশ’ গ্রামীণ জীবনের কাহিনী নিয়ে নির্মিত নাটকের সংকলন। প্রতিটি নাটক মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে। এখানে উঠে আসে গ্রামের মানুষের হাসি-কান্না, স্বপ্ন-ব্যর্থতা, সংগ্রাম-সফলতা সবকিছুই। তার নাটকে তুলে ধরেন গ্রামের রীতি-নীতি, জীবনযাত্রা, কষ্ট ও আশার গল্প। নাটকগুলো শুধু বিনোদন নয়, এগুলো সামাজিক প্রতিবাদের এক শক্তিশালী মাধ্যম। নাটকের মাধ্যমে তিনি মানুষের দুঃখ-কষ্টকে তুলে ধরেন সমাজের সামনে।
রিপন এখন তার কনটেন্ট থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে নিজের জীবন চালান এবং তার পুরো টিমের খরচ বহন করেন। পাশাপাশি গরিব ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তার জীবনের গল্প আমাদের শেখায়, দৃঢ় সংকল্প, ভালোবাসা ও পরিশ্রম দিয়ে জীবনে যে কোনো কঠিন বাঁধা পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব।
দরিদ্রতার অন্ধকার থেকে আলোর পথে — মানবতার এক জীবন্ত প্রতিমূর্তি রিপনের ‘স্বপ্ন তেইশ’ নাটকগুলো শুধু অভিনয় বা গল্প বলার মাধ্যম নয়। এগুলো এক একটি মানুষের জীবন, যার মাঝে লুকিয়ে থাকে স্বপ্ন, আশা, বেদনা আর অনিবার্য বাস্তবতার তিক্ততা। তার সৃষ্ট নাটকগুলো প্রত্যেকটি অসহায় মানুষের জীবনের গল্প বলে — যে গল্পগুলো চোখে জল আনে, হৃদয়ে ব্যথা দেয় এবং মনে গভীর করুণার স্পন্দন জাগায়।
একটা মায়ের কষ্ট, যার সন্তান জলের মতো নরম বৃষ্টির মতোই স্নেহশীল হলেও জীবনের কঠোর পরিশ্রম তাকে থামিয়ে রাখে; এক বাবার জীবনের স্বপ্ন, যাকে হারিয়ে দিতে হয়েছে তার একমাত্র সন্তানকে; এক তরুণীর আশা, যার মুখে হাসি থাকার পরও চোখে লুকানো দুঃখ হাজারো— এই সব গল্পগুলোই উঠে আসে রিপনের নাটকে।
তার প্রত্যেক নাটক যেন একটি বাস্তব ছবি, যা শুধু বিনোদন দেয় না, বরং সমাজের গভীর অসঙ্গতি তুলে ধরে। এ নাটকগুলো মানুষকে ভাবায়, চোখ খুলে দেয়, আরেকটু ভালোবাসার শিক্ষা দেয়।
রিপনের নিজের দুই মেয়ে বৃষ্টি ও শ্রাবনী, যাদের মুখে উঠে জীবনের নানা রঙ, আর শ্রাবনীর মায়ের কণ্ঠের কোমলতা সেই নাটকে প্রাণ ঢেলে দেয়। যখন তারা মঞ্চে দাঁড়ায়, তখন মনে হয় একেকজন শুধু অভিনেত্রী নন, তারা জীবনকে বোঝে, অনুভব করে। তাদের চোখে লুকানো কান্না আর হাসি কেবল নাটক নয়, এক জীবনের প্রতিচ্ছবি।
অন্য শিল্পীদের অভিনয়েও মানুষের যন্ত্রণার দোলা স্পষ্ট ঝলকায়। মোঃ মাসুদ রানা থেকে শুরু করে মোঃ সাব্বীর হোসেন পর্যন্ত প্রত্যেকেই নাটককে জীবন্ত করে তোলে। ক্যামেরার আড়ালে থাকা আলামিন হোসেনের দক্ষতা নাটকের আবেগকে আরো তীব্র করে তোলে।
এই পুরো দল মিলে যে গল্পগুলো বলেন, তা হৃদয় ছুঁয়ে যায়, মানুষের চোখে পানি এনে দেয়। তাদের অভিনয় দেখে অনেকেরই হৃদয়ে জেগে ওঠে নিজের জীবনের দুঃখ-কষ্টের কথা, আবার অনেকেরই মনে জাগে অন্যদের প্রতি সহানুভূতি।
রিপনের জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার হলো তার অসহায় মানুষের প্রতি ভালোবাসা। তার নাটকের আয় থেকে যা টাকা আসে, তা দিয়ে সে শুধু নিজের বা টিমের জীবন চালায় না, বরং দরিদ্র, অসহায় ও বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ায়। তার সেই ছোট্ট ছোট্ট সাহায্য হাজারো মানুষের জন্য জীবনের আলো হয়ে দাঁড়ায়।
একটি বিশেষ ঘটনা স্মরণীয়। একদিন একটি পরিবার ছিল, যাদের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য টাকা প্রয়োজন ছিল। রিপন তৎক্ষণাৎ তাদের পাশে দাঁড়ালেন এবং সেই মানুষটির জীবন বাঁচালেন।
এই কাজগুলো তার কেবলমাত্র মানবতার নিদর্শন নয়, বরং একটি শক্তিশালী সমাজ গঠনের এক উদাহরণ।
নাটকগুলো শুধুই দুঃখের গল্প নয়, এগুলো প্রতিবাদের ভাষা। সামাজিক অবিচার, দরিদ্রতা, বেকারত্ব, মানবাধিকার লঙ্ঘন — এসব নিয়ে তিনি নিজের নাটকে উচ্চস্বরে কথা বলেন। তার কাজ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করে, সমাজে পরিবর্তনের দরজা খুলে দেয়।
তার পেজে হাজার হাজার মানুষের মন্তব্য পড়লে বোঝা যায়, কিভাবে এক সাধারণ গ্রামের মানুষ তার আবেগপূর্ণ নাটকের মাধ্যমে হাজারো মানুষের জীবন পরিবর্তনের জন্য অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন। কেউ কেউ বলেন, “রিপনের নাটক দেখে আমি আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে নতুন করে ভাবতে শিখেছি।” আবার কেউ বলেন, “আমার চোখ থেকে এক সময় পানি থামত না।”
রিপনের পেজ ‘স্বপ্ন তেইশ’ শুধু একটি নাটক ও কনটেন্ট প্ল্যাটফর্ম নয়, এটি অসংখ্য মানুষের স্বপ্নের সেতুবন্ধন। যারা হারিয়ে গেছে আশার আলো, তারা সেখানে ফিরে পায় জীবনের নতুন অর্থ। যারা হারিয়েছে দিশা, তারা পায় নতুন পথ।
রিপনের প্রতিটি গল্পে সেই মানুষের কথা উঠে আসে, যারা নামলে থাকেন সমাজের অন্ধকারে, কিন্তু তার সৃষ্ট নাটকে তারা পায় আলো। তার ‘স্বপ্ন তেইশ’ হলো তাদের জীবনের এক আস্থার ঠিকানা।
রিপনের স্বপ্নের সীমা নেই। সে চায় তার নাটকের মাধ্যমে আরও বেশি মানুষের কষ্টের কথা পৌঁছে দিতে, তাদের জীবনে পরিবর্তনের বাতাস বইতে। তার লক্ষ্য শুধু নাটক নয়, বরং দেশের দরিদ্র, বঞ্চিত ও অসহায় মানুষের জন্য একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
রিপন এখনো কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তার টিমের সবার খরচ বহন করে যাচ্ছেন এবং অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
মাসুদ রানা—রিপনের নাটকে যে ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করেন—তিনি সত্যিই একজন অসাধারণ অভিনেতা। তার অভিনয় এতটাই প্রভাবশালী যে, দর্শকরা যখন তার অভিনয় দেখেন, তারা যেন বাস্তব জীবনের এক ভয়ঙ্কর চরিত্রের মুখোমুখি হচ্ছেন। তার এক্সপ্রেশন, কণ্ঠস্বরের মূড, ও সংলাপ পরিবেশন এতটাই প্রাঞ্জল যে, দর্শকের হৃদয়ে রাগ, উত্তেজনা এবং কখনও কখনও বিরক্তির অনুভূতি সৃষ্টি হয়।
মাসুদের অভিনয় এমন যে, সে সহজেই চরিত্রের ভেতর ঢুকে যায়, এমনকি এমন একজন খারাপ চরিত্রকেও মানুষ মনে করতে বাধ্য হয়। তার অভিনয় দেখে অনেকেই বলেন, “মাসুদ রানা যেন আমাদের চারপাশের কোনো বাস্তব মানুষের দৃষ্টান্ত!” রিপনের নাটকে মাসুদের উপস্থিতি নাটকের গল্পকে আরো প্রাণবন্ত ও শক্তিশালী করে তোলে।
তার অভিনয় শুধু ভিলেনি চরিত্রের জন্য নয়, বরং পুরো নাটকের আবেগ, থ্রিলার ও উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়। দর্শকরা মাসুদ রানার অভিনয় দেখে নাটকের প্রতি আরো বেশি আবেগী ও মনোযোগী হন। এটা নিশ্চিত যে, মাসুদ রানা’র অভিনয় নাটকের গল্পকে এক বিশেষ মাত্রা দিয়েছে যা সাধারণ দর্শককেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
সৎ মায়ের মেয়ে চরিত্রে যখন রিপনের মেয়ে বৃষ্টি ও শ্রাবনী অভিনায়ে আবির্ভূত হয়, তখন যেন সময় থমকে যায়। তারা শুধু অভিনয় করে না, বরং জীবনের কঠোর বাস্তবতা নিয়ে এসেছে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে। সৎ মা, যে মায়ের নয়, তবু মায়ের মতোই মমতা জড়িয়ে ধরে সন্তানের প্রতি, তার দায়িত্ববোধ আর ভালোবাসা ফুটিয়ে তোলে দুই মেয়ের নিখুঁত অভিনয়।
বৃষ্টি যখন সৎ মায়ের দুঃখ ও দায়িত্ববোধের সঙ্গে লড়াই করে, তখন তার চোখের কোণ থেকে ঝরে পড়ে এক অসহায় নারীর কথা। সে নারী, যাকে জীবনের কঠোর পরিকাঠামো কখনোই সহজে ছুঁয়ে দেয়নি শ্রাবনী, সৎ মায়ের নানা দ্বন্দ্ব ও বেদনার ছায়া নিয়ে উপস্থিত হয়। তার কণ্ঠের টানে, তার চোখের জলে আমরা দেখতে পাই একটি নারীর সংগ্রাম—কিন্তু সেই সংগ্রামের মাঝেও অসীম মমতা আর ধৈর্য। শ্রাবনী শুধু অভিনয় করেনি, সে জীবন দিয়েছে সেই চরিত্রকে, যার মাধ্যমে আমরা বুঝি, প্রকৃত মায়ের সংজ্ঞা কতটা বিস্তৃত।
রিপনের মেয়েদের এই অভিনয় আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সৎ মা হলেও মায়ের ভালোবাসার কোনো কমতি হয় না। এই ভালোবাসা কতটা গভীর এবং নির্ভরযোগ্য হতে পারে, সেটাও তারা প্রমাণ করেছে। তাদের অভিনয় দেখতে দেখতে দর্শকেরা অনিবার্য চোখে জল ধরে রাখতে পারে না, কারণ তারা শুধু অভিনয় নয়, জীবনই বাঁচিয়ে তুলেছে।
এই দুই মেয়ের অভিনয় যেন সমাজের ভ্রান্ত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে, যেখানে সৎ মাকে প্রায়ই অবহেলা বা ভুল বোঝার নজরে দেখা হয়। রিপনের নাটকে, তাদের অভিনয়ে আমরা দেখি, যে ভালোবাসা শুধু রক্তের সম্পর্ক নয়, বরং আন্তরিকতার এক অমোঘ বন্ধন।