ছাত্র-জনতার তীব্র গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতন হয় ফ্যাসিস্ট রেজিমের। চব্বিশের ৫ আগস্ট পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট অভূতপূর্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের মধ্য দায়িত্ব গ্রহণ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। বিচার, সংস্কার এবং সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের মতো গুরুদায়িত্ব নেওয়া এই সরকার গত এক বছরে কতটা সফল হয়েছে; প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসাব কতটা মেলাতে পেরেছে, সেটির মূল্যায়নে শনিবার দৈনিক যুগান্তর কার্যালয়ে ‘সরকারের এক বছর : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিকসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। তাদের বেশিরভাগেরই মত, বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় আসা সরকারের কাছে অন্য যেকোনো সরকারের চেয়ে প্রত্যাশা বেশি থাকে। ড. ইউনূসের সরকারের কাছেও তেমন প্রত্যাশা ছিল সবার। তবে সে প্রত্যাশা পূরণে বেশিদূর এগোতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু যেমনটি বলেছেন, ‘অর্থনৈতিক দিক থেকে এই সরকারের কোনো প্রাপ্তি নেই। বরং অর্থনীতি খারাপের দিকে গেছে।’ এছাড়া দেশে আইনের শাসন, সামাজিক শৃঙ্খলা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও হতাশার কথা শোনান তিনি।
দেশের বর্তমান অরাজক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দ্রুত অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এই বিএনপি নেতা বলেন, ‘দেশে নির্বাচিত সরকার লাগবে। আমরা যে নির্বাচন চাচ্ছি, সেটা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য, দেশের মানুষের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। যে অধিকারের জন্য মানুষ রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছে।’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাও সরকারের সংস্কার কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, এক বছরে সরকার একটা সংস্কারও কি বাস্তবায়ন করতে পেরেছে? পারেনি। এমনকি সরকার তার বাকি সময়েও খুব বেশি কিছু করতে পারবে বলে মনে করছেন না তিনি।
যদিও অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের কিছু সাফল্য অর্জিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির এবং অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ। এর মধ্যে গেল জুলাই অভ্যুত্থানের সময় পতিত সংঘটিত গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘের মাধ্যমে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং প্রণয়নের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার বিচারের ভিত তৈরি করেছেন বলে মনে করেন হুমায়ুন কবির।
অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে উন্নতি, ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মতো ইস্যুগুলোতে সরকারের সাফল্যকে সামনে এনেছেন আবু আহমেদ। এখনো অর্থনীতিতে কিছু সমস্যা থাকলেও এসব সাফল্যকে খাটো করে দেখা যাবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও বাকস্বাধীনতা পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপির) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন। তার ভাষায়, আমরা এখনো অনেক কিছু বলতে চেয়ে বলতে পারছি না।
একই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য মাহমুদা হাবিবা। ফ্যাসিবাদী আমলের মতো এখনো সরকারের সমালোচনা করলে মিডিয়া ট্রায়াল হয়, চাকরি হারানোর ঝুঁকি থাকে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এই বিএনপি নেত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, স্বৈরাচার নিপাত গেলেও এখনো কেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত?
অন্তর্বর্তী সরকার যে এখনো প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে পারেনি, এর পেছনে ফ্যাসিবাদের মূলোৎপাটনে ব্যর্থতার কথা সামনে এনেছেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদী। তিনি বলেন, বিপ্লবের প্রথম শর্ত হলো ফ্যাসিবাদের সব চিহ্ন ভেঙে দিতে হবে। কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি।
এবি পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ রাষ্ট্র সংস্কারের পাশপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের দিকে জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সংস্কার না করলে কিছুই পরিবর্তন হবে না।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেছেন, গেল এক বছরে দেশে কোনো বিনিয়োগ হয়নি। কারণ বিনিয়োগকারীরা দেশের ব্যবসার পরিবেশ সন্তোষজনক মনে করছেন না।
যুগান্তরের সম্পাদক আবদুল হাই শিকদারের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রধান প্রতিবেদক মাসুদ করিম।