বেশ কিছু ব্যাংক খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রেখেছিল। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ বের করে আনতে উদ্যোগ নেয়।
পাশাপাশি ঋণ খেলাপির সময় ছয় মাসের পরিবর্তে আন্তজাতিক মান (ব্যাসেল-৩) অনুসরণ করে তিন মাস নির্ধারণ করে। এরপর থেকে খেলাপি ঋণ অব্যাহতভাবে বাড়ছে।
দায়িত্ব নেওয়ার চার মাসের মাথায় ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “আমরা দেশের আর্থিক খাতের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছি। সামনে খেলাপি ঋণ ২৫-৩০ শতাংশে পৌঁছে যাবে। এখন যা সাড়ে ১২ শতাংশ। আগামী মাসে তা ১৫ শতাংশ, এরপর ১৭ শতাংশ হয়ে ধীরে ধীরে ৩০ শতাংশে পৌঁছে যেতে পারে। এই খেলাপি আগেই হয়ে আছে। এখন হিসাবে তা আসবে। ”
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রস্তুতকৃত খেলাপি ঋণের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৩০ জুন থেকে চলতি বছরের ৩০ মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে খেলাপি ঋণ স্থিতি (আউটস্ট্যান্ডিং) বেড়েছে ৫৮ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা। আর খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা।
তথ্য বলছে, চলতি ২০২৫ সালের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪.১৪ শতাংশ। এ সময় ঋণ স্থিতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। আর ২০২৪ সালের ৩০ জুন দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ১২.৫৪ শতাংশ। সে সময় ঋণ স্থিতি ছিল ১৬ লাখ ৮৩ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা।
বের হয়ে আসছে লুকায়িত দুর্বলতা
দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত, বেসরকারি ও বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি। এর মধ্যে ২৩ বাণিজ্যিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১৫ শতাংশ থেকে উপরে। যার মধ্যে কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫০ থেকে ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত। এর কিছু গত কয়েক বছর ধরে উচ্চ খেলাপি ঋণের ভারে আক্রান্ত হয়ে আছে। আর কিছু গত ৯ মাস সময়ের মধ্যে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৫ শতাংশের উপরে
৯ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মধ্যে ৬টির গড় খেলাপি ঋণের হার ৪৫.৭৯ শতাংশ। আর তিন বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১৪.৪৭ শতাংশ। দুই ব্যাংকের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই খেলাপি। তবে ৯ মাসে নতুন করে অস্বাভাবিকভাবে খেলাপি ঋণ বাড়েনি এসব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন মাসে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৩২৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৩০.৫৯ শতাংশ। ২০২৫ সালের মার্চে এসে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯ হাজার ৭২০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের ৪১.৩৫ শতাংশ। ৯ মাসের ব্যবধানে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণে বেড়েছে ৮ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের বর্তমান খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৮০ কোটি ৭২ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ৪৫.৬৮ শতাংশ। ২০২৪ সালের জুন মাসে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৪৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের ৪২.৩০ শতাংশ।
বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮ হাজার ৬৪৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। আর খেলাপি ঋণের হার ৬৯.৩৪ শতাংশ। ৯ মাস আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। খেলাপির হার ছিল ৬৪.৪৫ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭০ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭৪.৭৬ শতাংশ। ৯ মাস আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৮ হাজার কোটি ৪৫ লাখ টাকা। আর খেলাপি ঋণের হার ছিল ৫২.৫৫ শতাংশ।
রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৭ হাজার ১২৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। ৯ মাসে আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ৪৬৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। খেলাপি ঋণের হার ছিল ২৩ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৯ হাজার ৯১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২১.১১ শতাংশ। ৯ মাস আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। আর খেলাপির হার ছিল ১৪.৮১ শতাংশ।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৯০২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১৪.১১ শতাংশ। ৯ মাস আগে ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ।
আরেক বিশেষায়িত ব্যাংক রাজশাহী কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের ১৭.২৬ শতাংশ। ৯ মাস আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৪১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
তুলনামূলক কম বয়সী রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক স্বগোত্রীয় জনতা, বিডিবিএল ও বেসিক ব্যাংককে শক্তভাবে অনুসরণ শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠার এক দশকেই ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ১১ শতাংশ। ব্যাংকটির ২ হাজার ৭৪২ কোটি টাকার মোট ঋণের মধ্যে ৩১৪ কোটি টাকাই খেলাপি।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কম। রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের অবস্থা নাজুক।
বেসরকারি ব্যাংকে ১৫ শতাংশের উপরে খেলাপি ঋণ
দেশে বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ৪৩টি। এসব ব্যাংকের গড় খেলাপি ঋণের হার ২০.১৬ শতাংশ। এরমধ্যে ১৫ শতাংশের উপরে খেলাপি ঋণ ১২টির। আর ৫ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫০-৯০ শতাংশ পর্যন্ত।
বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংকে ২০২৫ সালের মার্চ মাসে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ২৬.৩২ শতাংশ। ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮ হাজার ৮৪০ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ৯ মাসে আগে ২০২৪ সালের জুন মাসে এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা। আর খেলাপি ঋণের হার ৩০.৯৫ শতাংশ। দেশি-বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে শুধু এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমেছে।
আল আরাফা ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৭৯৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের ১৫.৫৭ শতাংশ। ৯ মাস আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ছিল ৩ হাজার ১১০ কোটি ২৩ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের ৬.৪৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক হাজার ৫৩০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬৭.১৮ শতাংশ। ২০২৪ সালে ৩০ জুন ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৩১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের ৫৬ শতাংশ।
ব্যাংক এশিয়ার বর্তমান খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৫৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, যা ব্যাংটির মোট ঋণের ১৪.৩৫ শতাংশ। ৯ মাস আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ছিল ৭.৮৫ শতাংশ। আর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩৮৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৬.৬৩ শতাংশ। ৯ মাস আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬৯০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। খেলাপি ঋণের হার ছিল ৪.৫৩ শতাংশ।
বর্তমানে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৯৪২ কোটি ১০ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের ৫৪.৩৬ শতাংশ। ৯ মাসে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩২৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। তখন ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ছিল ২.৩৬ শতাংশ।
আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৬৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা, যা খেলাপি ঋণের ৯১ শতাংশ। ৯ মাস আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৭৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। খেলাপি ঋণের হার ছিল ৮৯ শতাংশ।
দেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৭ হাজার ৬১৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের ২৭.৩৮ শতাংশ। ৯ মাস আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৭২৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। আর খেলাপি ঋণের হা্র ছিল ৪.৪২ শতাংশ।
বর্তমানে ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬৪ শতাংশ। ৯ মাসে আগে ২০২৪ সালের ৩০ জুনে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৯২৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা। তখন খেলাপি ঋণের হার ছিল ৪৯ শতাংশ।
এনবিআর ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৬৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। খেলাপি ঋণের হার ১৮.২২ শতাংশ। আগের বছর জুন মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৪৬ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের হার ছিল ৫.৮৩ শতাংশ।
এনআরবি কমার্স ব্যাংকের বর্তমান খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৪২১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। খেলাপি ঋণের হার ১৬.২০ শতাংশ। ৯ মাস আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২০৩ কোটি টাকা আর খেলাপি ঋণের হার ছিল ৭.২৯ শতাংশ।
পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৮৭৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা। খেলাপি ঋণের হার ৮৭.১৮ শতাংশ। ৯ মাস আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৮৮১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। খেলাপি ঋণের হার ছিল ৮৫.৭৩ শতাংশ।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ২৯ শতাংশ। ৯ মাস আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭৭১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। আর খেলাপি ঋণের হার ছিল ৫.৭৯ শতাংশ।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের পরিমাণ ১৪ হাজার ৩৪৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা। খেলাপি ঋণের হার ৩৭.৫৮ শতাংশ। ৯ মাস আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৭৭৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। তখন খেলাপি ঋণের হার ছিল ৪.৭৭ শতাংশ।
ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। আর খেলাপি ঋণের হার ৮৯.৮১ শতাংশ। ৯ মাস আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। আর খেলাপি ঋণের হার ছিল ৩.৪২ শতাংশ।
ইউনাইটেড কমাশির্য়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮ হাজার ৬২৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। আর খেলাপি ঋণের হার ১৪.৬৭ শতাংশ। ৯ মাস আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৩১৩ কোটি ১২ লাখ টাকা। আর খেলাপি ঋণের হার ছিল ৬ শতাংশ।
বেসরকারি খাতের একমাত্র ব্যাংক এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পরিস্থিতির অবনতি হয়নি, বরং উন্নতি হয়েছে।
একটি বিদেশি ব্যাংকের খেলাপির হার ৯৯ শতাংশ
বাংলাদেশে ব্যবসারত আছে ৯টি বিদেশি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের মধ্যে আটটি ব্যাংক আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখার পাশাপাশি খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসা করছে। একমাত্র ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের মোট ঋণের ৯৯ শতাংশই খেলাপি ঋণ। ব্যাংকটির বর্তমান খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৩৫৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ৯ মাসে আগে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার ছিল ৯৬.১ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা যা বলছেন
আর্থিক খাতের এই অবস্থাতে খেলাপি ঋণের হার আরও বাড়বে। বর্তমান গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর ঋণ ব্যবস্থাপনার আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ শুরু করেছেন। এতে ঋণের ৩০ শতাংশ এমনিতেই খেলাপি হয়ে যাবে। তবে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ সহনীয় পর্যায়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, ব্যাসেল-৩ স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ শুরু করার পর ঋণের কিস্তি পরিশোধের সীমা ছয় মাস থেকে নেমে তিন মাস হয়েছে। এখন ঋণের কিস্তি তিন মাসে পরিশোধ না করলেই খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। এটা শুরু করার কারণে খেলাপি ঋণের হার নিশ্চিতভাবে ৩০ শতাংশের উপরে চলে যাবে।
বিআইবিএমের এই সাবেক মহাপরিচালক আরও বলেন, ঋণ শ্রেণিকরণে ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী কিস্তি তিন মাস পরিশোধ না করলেই তা প্রাথমিক মানের খেলাপি বা নিম্নমান হয়ে যাবে। মেয়াদোত্তীর্ণের সময়সীমা ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে হলে নিম্নমান, ৬ থেকে ১২ মাসের মধ্যে সন্দেহজনক ও ১২ মাসের অধিক হলে মন্দ ঋণ হবে। খেলাপি ঋণের এই পর্যায় অনুসারে বিভিন্ন অনুপাতে প্রভিশনও রাখতে হয়। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় ছিল ৬ মাস। ফলে এখন ঋণ পরিশোধে অসতর্ক প্রথম ধাপের খেলাপি হয়ে যাবে।
তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক ব্যবসায়ী দেশ ছেড়েছেন, ঋণের কিস্তি দিতে পারেননি। অনেকে রাজনৈতিক সংকটের কারণে ঋণ ফেরত দিতে পারেননি। সেই সঙ্গে অতীতে বিভিন্ন ব্যাংকে আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এসব কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
তিনি বলেন, এখন খারাপ ঋণ দেওয়া হচ্ছে না, সুশাসন ফিরে আসছে। তারপর ব্যাংকের যেসব বাজে পরিচালক খারাপ ঋণ দিতে প্রভাব বিস্তার করতেন তাদের উপস্থিতি কমে আসছে। বেশ কিছু ব্যাংকের পুনর্গঠন করা হয়েছে। যে ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়নি, সেগুলো সতর্ক হয়ে গেছে।
উত্তরণের পথ কী
যে ব্যাংক উচ্চ খেলাপির পাঁকে পড়েছে, শুধু খেলাপি হওয়ার টাকাই আটকে যায়নি, খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়েছে। প্রভিশন হলো, খেলাপি ঋণের বিপরীতে ধরন ভেদে ব্যাংকের মুনাফা থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে রেখে দেওয়া। প্রভিশনকে ঋণের নিরাপত্তা সঞ্চিতিও বলা হয়। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া মানেই একই সঙ্গে ব্যাংকটিকে দুর্বল করে দেওয়া, আর্থিক খাতের সক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া এবং টাকাকে অলস করে দেওয়া।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ঋণ ব্যবস্থাপনায় নিবিড় পর্যবেক্ষণের তাগিদ দেন তৌফিক আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, সকল খেলাপি ঋণ দুইভাগে ভাগ করতে হবে। প্রথমত ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ; দ্বিতীয়ত অনিচ্ছাকৃত খেলাপি বা পরিস্থিতির শিকার হয়ে খেলাপি। যেটা ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ, সেটার প্রক্রিয়া ভিন্ন হবে। অনিচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ সামাজিক, রাজনৈতিক, অথনৈতিক কারণে হয়েছে। অর্থাৎ সত্যিকারের কারণে খেলাপি হয়েছে। সেগুলোকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। যেগুলো ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয়েছে, সেগুলো সহজ হ্যান্ডেল করা যাবে না।
তিনি বলেন, প্রতিটি ব্যাংকেই ওয়ার্কআউট বিভাগ থাকতে হবে, যারা খেলাপিদের সঙ্গে বসবে। কী কারণে খেলাপি হয়েছে, মার্কেট না পাওয়ার কারণে, রপ্তানি করে রপ্তানি আয় না আসা, নাকি কাঁচামাল না পাওয়ার কারণে! এগুলো খুঁজে বের করে ঋণের পূণর্গঠন করার ব্যবস্থা করতে পারে। যারা অনিচ্ছাকৃত খেলাপি, ঋণ ফেরত দিতে তত বেশি অনীহা নেই, তারা সুযোগ পেলেই ঋণ ফেরত দেবে। কিন্তু তাদের সঠিকভাবে অ্যাড্রেস করতে হবে। যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে যে ব্যাংকের আদৌ ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব না, এমন দুই-একটি ব্যাংক বন্ধ করে দিতে হবে।
ব্যাসেল-৩ স্ট্যান্ডার্ড অনেক দিন থেকেই কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কার্যকর করা যায়নি। কার্যকর করার উদ্যোগ নেওয়া হলে ব্যবসায় হোঁচট খাবে, খেলাপি হয়ে যাচ্ছে, ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে—অনেকে এ ধরনের আওয়াজ তুলেছেন। এভাবে অনেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন উল্লেখ করে বিআইবিএমের সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, এটা শুরু হয়েছে, বাস্তবায়ন করতে হবে। এখনই সময়। এখন যতটা সম্ভব, রাজনৈতিক সরকার এলে তা মোটেও করা সম্ভব নয়।