রাজসাক্ষী কী, আইনি সুবিধা কতটা?

Share

জুলাই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রথম কোনো মামলায় আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়েছে। সারা দেশে হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ বা বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত মূল অপরাধী হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত।

এরপর আসামিদের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের সময় দায়িত্বরত পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন দোষ স্বীকার করেছেন। একইসঙ্গে তিনি রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করলে আদালত তা মঞ্জুর করেছেন।
আইনগতভাবে রাজসাক্ষীর সাজা মওকুফসহ কম দণ্ড পাওয়ার সুযোগ আছে। তবে তার সাক্ষ্য সন্দেহজনক হলে বিচারক সেই সুবিধান নাও দিতে পারেন।

রাজসাক্ষী কী?
রাজসাক্ষী হলেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার পরও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে অপরাধের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করেন এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসেবে কাজ করেন।

আরও সহজভাবে বলতে গেলে- রাজসাক্ষী মানে অপরাধে জড়িত একজন ব্যক্তি, যে পরে আদালতের কাছে সব সত্য বলে দেয় এবং অপরাধের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়।

ধরা যাক, পাঁচজন মিলে একজনকে খুন করেছে। তাদের মধ্যে ধরা পড়া একজন পুরো ঘটনা আদালতে খুলে বলে—কে কী করেছে, কীভাবে খুনটি হয়েছে। সেই ব্যক্তি তখন রাজসাক্ষী হয়ে যায়।

রাজসাক্ষী হওয়ার উদ্দেশ্য কী?
অনেক সময় শাস্তি লাঘব বা মুক্তির আশায় একজন অপরাধী রাজসাক্ষী হয়।

এতে করে রাষ্ট্রপক্ষ অপরাধ প্রমাণ করতে সহজে ও শক্তিশালী সাক্ষ্য পায়।

রাজসাক্ষী কী সুবিধা পাবেন?
বাংলাদেশে প্রচলিত ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় রাজসাক্ষী হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭ ও ৩৩৮ ধারায় এ সংক্রান্ত বিধান রয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধ তদন্ত, অনুসন্ধান বা বিচারের যেকোনো পর্যায়ে অপরাধটির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত বা সে সম্পর্কে গোপন তথ্যের অধিকারী বলে অনুমিত কোনো ব্যক্তির সাক্ষ্য সংগ্রহের উদ্দেশে তাকে এই শর্তে ক্ষমা করার প্রস্তাব দিতে পারেন যে, তার জানা মতে অপরাধ সম্পর্কিত সামগ্রিক অবস্থা এবং উহা সংঘটনের ব্যাপারে মূল অপরাধী বা সহায়তাকারী হিসেবে জড়িত প্রত্যেকটি লোক সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ও সত্য ঘটনা প্রকাশ করলে তাকে ক্ষমা করা হবে।

১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১৩৩ ধারা মোতাবেক এ ধরনের ব্যক্তির ব্যক্তিকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ রয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, দুষ্কর্মের সহযোগী আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তি বলিয়া গণ্য হইবেন।

এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, আমাদের ফৌজদারি আইনের বিধান অনুযায়ী রাজসাক্ষী দোষ স্বীকার করে বক্তব্য দেবেন। সেক্ষেত্রে আদালত তার সাজা মওকুফ করতে পারে বা তাকে সুবিধা দিতে পারে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের বিধান
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাজসাক্ষী হওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত আইন নয় বরং নিজস্ব বিধান রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ইতোপূর্বে অনেকের বিচার হয়েছে। জামায়াতের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতার ফাঁসিও এই ট্রাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী কার্যকর করা হয়েছে। তবে ট্রাইব্যুনালে ইতোপূর্বে কোনো আসামির রাজসাক্ষী হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। সেই হিসেবে এই ট্রাইব্যুনালে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনই প্রথম রাজসাক্ষী হতে যাচ্ছেন।

১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩ এর ১৫ ধারা অনুযায়ী এ ধরনের রাজসাক্ষী হিসেবে সহ-অভিযুক্তকে পরীক্ষা করার বিধান রাখা হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, একজন অনুমোদনকারীকে ক্ষমা। (১) বিচারের যেকোনো পর্যায়ে, একটি ট্রাইব্যুনাল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উল্লিখিত যেকোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত বা গোপনীয়তার সঙ্গে সম্পর্কিত যেকোনো ব্যক্তির প্রমাণ প্রাপ্তির লক্ষ্যে ধারা ৩-এ, এই ধরনের ব্যক্তিকে অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত জ্ঞানের মধ্যে পরিস্থিতির সম্পূর্ণ ও সত্য প্রকাশ করার শর্তে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে ক্ষমা করার শর্তে, তা প্রধান বা প্ররোচনাকারী হিসেবে হোক না কেন।

(২) এই ধারার অধীনে দরপত্র গ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিচারে সাক্ষী হিসেবে পরীক্ষা করা হবে।

(৩) এই ধরনের ব্যক্তিকে বিচারের সমাপ্তি না হওয়া পর্যন্ত হেফাজতে আটক রাখা যাবে।

রাজসাক্ষী কী আইনগত সুবিধা পেতে পারেন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন রাজসাক্ষীকে বিচারক ক্ষমা করতে পারেন। তবে তার এই ক্ষমা পাওয়া নির্ভর করে তার বক্তব্য কতটা বিশ্বাসযোগ্য তার ওপর।

ট্রাইব্যুনালের একজন প্রসিকিউটর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই আইনের ১৫ ধারার বিধান মোতাবেক রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। ট্রাইব্যুনাল সেই আবেদন মঞ্জুর করেছেন। এখন আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী হিসেবে তাকে পরীক্ষা করতে ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করবে প্রসিকিউশন। যতদিন মামলা নিষ্পত্তি না হবে ততদিন তাকে কারাগারে আটক রাখা হবে। আসামিকে শুনানির জন্য ধার্য তারিখ সমূহে ট্রাইব্যুনালে আনা হবে। তাকে সাক্ষীর জন্য ডকে হাজির হয়ে সাক্ষী দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হবে। অত্র মামলার অপর আসামিপক্ষ তাকে জেরা করতে পারবেন।

রাজসাক্ষী হওয়ায় আব্দুল্লাহ আল মামুনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে কি না- এমন প্রশ্নে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এটা আদালত নির্ধারণ করবেন। আমাদের আইনে বলা হয়েছে, তিনি যখন সাক্ষ্যের মাধ্যমে পুরো সত্য ধরবেন, তখন আদালত তাকে ক্ষমা করতে পারেন বা অন্য কোনো আদেশ দিতে পারেন। এটা কমপ্লিটলি আদালতের এখতিয়ার।

এ ধরনের রাজসাক্ষী করার বিষয়ে রাষ্ট্রের বা অভিযুক্তের কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে- জানতে চাইলে ব্যারিস্টার জ্যের্তিময় বড়ুয়া বলেন, রাজসাক্ষী সে হয়, যে অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে। রাষ্ট্র কর্তৃক তাকে এই অফার দেওয়া হয় যে, তুমি যদি অন্যান্য সহ-অপরাধী যারা আছে তারা যা করেছে সে বিষয় রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষী দাও তাহলে তোমার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন করবো না। এখানে দুই পক্ষের বেনিফিট দুই রকম। যিনি রাজসাক্ষী হচ্ছেন তিনি টেকনিক্যালি স্বীকার করলেন অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, কিন্তু এখন রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করবেন। আর রাষ্ট্রের সুবিধা হচ্ছে ভালো সাক্ষ্য পাচ্ছে।

তবে একজন আসামি রাজসাক্ষী হলেই অন্যরা অপরাধী এমনটা মানতে নারাজ শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। শুনানি শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দশজনের ভেতর একজন আসামি দোষ স্বীকার করতে পারে। তার ভেতরে ব্যক্তিগতভাবে কোনো অপরাধ থাকতে পারে। অন্য আসামিদেরতো দোষ নাও থাকতে পারে। অতএব এর দ্বারা কীভাবে বুঝবো যিনি দোষ স্বীকার করেছেন সেজন্য অন্যরাও সবাই দোষী, এটা বলা যাবে না।

তিন আসামির বিরুদ্ধে যে ৫ অভিযোগ: আন্দোলনের মুখে পালিয়ে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে হত্যা, ষড়যন্ত্রসহ পাঁচটি বিষয়ে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় (সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি), ষড়যন্ত্র, উসকানি, হত্যা, পরিকল্পনাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ।

এসব অভিযোগে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলার সময়ে জুলাই-আগস্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চালানো গুলিতে প্রায় দেড় হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আহত হন প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। অনেকেই স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে গেছেন, চোখ হারিয়েছেন অনেকেই। হত্যার নির্দেশ, প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, ষড়যন্ত্র ও সম্পৃক্ততার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন শেখ হাসিনাসহ তিন আসামি।

এর আগে গত ১২ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনে রিপোর্ট দাখিল করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। গত ১ জুন শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল।

গত ১ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিচার শুরুর আবেদন করে প্রসিকিউশন। সে অনুযায়ী বৃহস্পতিবার বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠনের আদেশ দেন। তবে দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ায় তাকে চার্জ থেকে বাদ দেওয়া হয়। এরপর মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ৩ ও ৪ আগস্ট সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।

Read more