লিবিয়ার ৩ ক্যাম্পে আটক ৫ শতাধিক বাংলাদেশি

Share

ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে ইতালি যাওয়ার পথে লিবিয়ার তিন শহরে মানব পাচার চক্রের ৩ ক্যাম্পে আটক রয়েছেন ৫ শতাধিক বাংলাদেশি। ত্রিপোলি, বেনগাজী ও মিশ্রতা শহরের তিন ক্যাম্পে আটক এসব বাংলাদেশির ওপর চলছে অমানুষিক নির্যাতন। ভয়ংকর এই মাফিয়া চক্রের সঙ্গে সরাসরি জড়িত আছে লিবিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মিলিশিয়া গ্রুপ। মুক্তিপণের দাবিতে তারা শুধু বন্দিদের হাত-পা বেঁধে নির্যাতনই নয়, ঠিকমতো খেতেও দেয় না। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মারাও গেছেন অনেকে। এসব তথ্য জানিয়েছেন ক্যাম্প নামক মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসা বাংলাদেশি যুবক তানজির শেখ। তিনি লিবিয়ার ত্রিপোলির ক্যাম্পে ৯ মাস অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তবে, সৌভাগ্যক্রমে বুধবার তিনি দেশে ফিরতে সক্ষম হয়েছেন। কুষ্টিয়া শহরতলির জগতি এলাকার সিরাজ শেখের ছেলে তানজির ছাড়াও ইতোমধ্যে মুক্তিপণ দিয়ে সেই মৃত্যুকূপ থেকে ফিরেছেন আরও ৪ তরুণ। এদের মধ্যে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কুর্শা কারদারচর এলাকার ওহিদুলের ছেলে আসিফ ২২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। তিন দিন আগে তিনিও দেশে ফিরেছেন। একই উপজেলার কালাম ২৭ লাখ টাকা দিয়ে ওই চক্রের কাছ থেকে ছাড়া পেয়েছেন। পরে তিনি আরও ৩২ লাখ টাকা দিয়ে লিবিয়া থেকে ইতালি চলে গেছেন। চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার কালিদাশপুর এলাকার রবিউল ইসলামের ছেলে খাইরুল ইসলাম ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে দেশে ফিরেছেন। সর্বশেষ বুধবার ঝিনাইদহের মহেশপুরের মতিউর রহমান সাগর ২০ লাখ ও কুষ্টিয়ার তানজির শেখ ৩৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে দেশে ফিরেছেন।

তানজির জানান, লিবিয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহযোগিতায় ভয়ংকর মাফিয়া চক্র গড়ে তুলেছে বাংলাদেশিরা। দুই দেশেই এই চক্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। লিবিয়া পুলিশের সহযোগিতায় মাদারীপুরের পিচ্চি সোহেল ও সেখানকার নাগরিক ওসামার ক্যাম্পে বাংলাদেশিদের জিম্মি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের তিন হাতে বিক্রি হতে হতে ক্যাম্পে ঢুকতে হয়। ইতালিতে নেওয়ার কথা বলে প্রথমে বাংলাদেশের দালালরা আমাদের লিবিয়ার বাংলাদেশিদের কাছে বিক্রি করে দেয়। দ্বিতীয় ধাপে ইতালিতে পাঠানোর কথা বলে রাস্তা থেকে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মিলিশিয়ার হাতে তুলে দেয় চক্রের সদস্যরা। তৃতীয় ধাপে মিলিশিয়া বাহিনী ৩ থেকে ৪ হাজার দিনারে আমাদের মাফিয়া চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়।

লিবিয়ার তিনটি জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাফিয়া চক্রের তিনটি ক্যাম্প রয়েছে। ত্রিপোলির জাওয়া, বেনগাজীর গানফুদা ও মিশ্রতা শহরের অজ্ঞাত অঞ্চলে এই তিনটি ক্যাম্প অবস্থিত। তানজির জানান, শুধু জাওয়া ক্যাম্পেই আড়াইশ থেকে তিনশ বাংলাদেশি আটক রয়েছেন। যাদের অধিকাংশের বাড়ি শরীয়তপুর ও মাদারীপুর, মাগুরা, সিলেট, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নওগাঁ ও নাটোর জেলায়। এছাড়া বেনগাজী ও মিশ্রতা জেলার ক্যাম্পেও আরও কয়েকশ বাংলাদেশি আটক বলে জানতে পেরেছি।

ক্যাম্পে ৯ মাসের অমানবিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে তানজির বলেন, রুটিন করে তিন বেলা আমাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চলত। কখনো রড দিয়ে, কখনো কোদালের আছাড়ি দিয়ে, আবার কখনো মোটা তার দিয়ে দীর্ঘ সময় পেটানো হতো। মেরে মেরে শরীর ফাটিয়ে ফেলত। ক্ষত জায়গায় ইনফেকশন হয়ে পচন ধরত। কখনো ভাত খেতে দিত না। আমাদের হাত-পা বেঁধে রাখা হতো। আর নির্যাতনের এসব ভিডিও করে আমাদের পরিবারের কাছে পাঠানো হতো। ভিডিও পাঠিয়ে মোবাইলে কল করে দাবি করা হতো মুক্তিপণ। পরিবার থেকে টাকা দিতে না চাইলে বেড়ে যেত নির্যাতনের মাত্রা। সেখানে আটক অধিকাংশ বাংলাদেশির শরীর শুকিয়ে হাড় বেরিয়ে গেছে। শুধু পাউরুটি ও পানি খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে। আবার পানি চাইলে নোনা পানি খেতে দেওয়া হয়। ওই পানি খেয়ে অনেকের শরীরে পচন ধরেছে। অনেকের শরীর দিয়ে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে এবং শরীরে পোকা ধরে গেছে।

তানজির বলেন, আমি যেদিন ত্রিপোলির ক্যাম্প থেকে ছাড়া পেয়েছি, সেদিন আমার সামনেই দুজন মারা গেছেন। তাদের একজনের বাড়ি কুষ্টিয়ার মিরপুরে এবং অপরজনের বাড়ি কুমিল্লায়। নির্যাতনের কারণে তাদের শরীরে পচন ধরেছিল।

তানজির দাবি করেন, ১৩ জনের একটি চক্র এ অঞ্চলে মানব পাচারে জড়িত। বাংলাদেশি দালালরা ভালো কাজের লোভ দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকায় আমাদেরকে লিবিয়ায় পাচার করে। কুষ্টিয়া অঞ্চলে এই চক্রের মূল হোতা কুষ্টিয়া সদরের পাটিকাবাড়ি ইউনিয়নের মিয়াপাড়ার আয়নালের ছেলে রবিজুল ও একই ইউনিয়নের নলকুলার আফাজ উদ্দিনের ছেলে আল-আমিন। তানজিরের বাবা সিরাজ শেখ বলেন, ভালো চাকরি ও ভালো বেতনের প্রলোভন দিয়ে আমার ছেলেকে লিবিয়ায় পাঠায় কুষ্টিয়ার রবিজুল। তার সঙ্গে আমার ১১ লাখ টাকার চুক্তি ছিল। প্রথমে ৫ লাখ টাকা দিই, এরপর আমার ছেলেকে লিবিয়াই পাঠিয়ে দেয়। এরপর বাকি ৬ লাখ টাকা পরিশোধ করি। এরপর ইতালি পাঠানোর কথা বলে ছেলেকে মাফিয়া চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়।

ছেলে বন্দি থাকা অবস্থায় রবিজুল আরও ২৫ লাখ টাকা দাবি করে। এর কিছুদিন পর রবিজুল বাড়ি থেকে পালিয়ে আত্মগোপনে যায়। এরপর নলখোলা গ্রামের আলামিন নামের একজন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং আমার ছেলেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করবে বলে প্রলোভন দেখায়। সে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টাকা নেয়। এতে কোনো কাজই হয়নি। এরপরে মাফিয়াদের আরও ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে এনেছি। রবিজুল ও আল-আমিনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

ব্র্যাক, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ট্র্যাফিকিং ইন পারসনস (টিআইপি) অফিস, ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) ওয়াশিংটনের দপ্তর এবং ইন্টারন্যাশনাল জাস্টিস মিশনের (আইজেএম) সমন্বিত প্রচষ্টায় কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহের দুই তরুণকে আইনি জটিলতা কাটিয়ে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনে।

ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম এন্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান বলেন, ‘ইউরোপে পাঠানোর লোভ দেখিয়ে যাদের লিবিয়া নেওয়া হয়, তাদের সবাইকে ইতালিতে ভালো চাকরির কথা বললেও তারা কিন্তু চাকরি পায় না। উলটো অধিকাংশকেই লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এরপর তাদের জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হয়। তবে এতকিছুর পরেও ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে বাংলাদেশের মানুষের ইউরোপের স্বপ্নে লিবিয়া যাওয়ার এই প্রবণতা থামছে না।’ কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মিজানুর রহমান বলেন, মানব পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। এসব মামলা আমরা গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখছি। কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তানজিরের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে এবং এ ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।

Read more