ঢাকা টাওয়ার ডেস্ক —
ফিলিস্থিনের গাজায় ইসরায়েলের নৃশংস হামলার ৬০০ দিন পেরিয়ে গেলেও এই সময়ের মধ্যে ৫৪,০০০ এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
তারপরও গাজার মানুষ মনোবল হারাননি, এ নিয়ে মিডল ইস্ট মনিটরে লিখেছেন ইতিহাসবিদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ সাইয়েদ মার্কোস তেনোরিও, ১ জুন লেখাটি মিডল ইস্ট মনিটরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়।
আমি ইসরায়েলসহ বিভিন্ন দেশের অনেক বিশ্লেষকের লেখা পড়ছি, যাঁরা প্রশ্ন তুলছেন—এত দিন ধরে গাজায় নির্বিচার ব্যাপক বিমান ও স্থল হামলা চালানোর পরও কেন ইসরায়েল সফল হতে পারছে না !
নেতানিয়াহুর ‘নাৎসিসদৃশ’ জায়নবাদী সরকার যুদ্ধের যে তিন মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল, সেগুলোর কোনোটিই এখনো অর্জিত হয়নি। যেসব প্রশ্ন এখন সবচেয়ে বেশি সামনে এসেছে, তা হলো ‘ইসরায়েল এখনো হামাসকে ধ্বংস করতে পারছে না কেন?’ ‘এ অবস্থার কারণ কী?’ ‘হামাস এত সাহস পায় কোথা থেকে আর তারা কি ভাঙার মতো নয়?’
এসব প্রশ্ন থেকেই বোঝা যায়, অনেকে বুঝতে পারছেন না যে হামাস হলো এক কঠিন প্রতিপক্ষ এবং ফিলিস্তিনি জনগণ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাঁরা নিজেদের ভূমি ছেড়ে যাবেন না এবং নিজেদের শেষ পর্যন্ত রক্ষা করবেন।
গাজায় ইসরায়েলে অব্যাহত নৃশংস হামলায় অনেক অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে, প্রতিরোধ নেতাদের কেউ কেউ নিহত হয়েছেন। তারপরও ইসরায়েল গাজায় বিজয় অর্জন করতে পারেনি। হামাস এখনো টিকে আছে, লড়ছে এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে বারবার একই এলাকায় ফিরে যেতে বাধ্য করছে।
প্রাথমিক যে উপসংহার আমরা টানতে পারি, সেটা হলো জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের ‘যুদ্ধযন্ত্র’ ব্যর্থ হয়েছে। তারা গাজায় একধরনের ‘অবসাদ ও ক্ষয়যুদ্ধের’ মধ্যে আটকা পড়েছে। ফলে ইসরায়েলি নেতাদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দিয়েছে, ইসরায়েলি সমাজে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে, সেনাবাহিনী মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে, প্রচুর সেনা মানসিক অবসাদে ভুগছেন এবং আত্মহত্যার হার বেড়ে গেছে। এসব কারণে অনেক সেনাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে হচ্ছে। ইসরায়েলের জানা দরকার, তারা প্রতিটি যুদ্ধে জয়ী হতে পারে, কিন্তু পুরো যুদ্ধে তারা হারছে।
নেতানিয়াহুর আকঙ্ক্ষা ছিল, গাজার ২১ লাখ ফিলিস্তিনিকে বোমা মেরে ও অনাহারে রেখে ধ্বংস করে দেওয়া। তিনি প্রতিদিনই নির্মম ও বর্বর উপায়ে তা করে যাচ্ছেন। অথচ পশ্চিমা শক্তিগুলো এ গণহত্যা বন্ধে শুধু কথার বুলি শুনিয়ে যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি ইসরায়েলকে শ্রদ্ধা দেখাতে বাধ্য করতে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
গাজা খালি করার পরিকল্পনাও দিনের পর দিন ব্যর্থ হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো নেতাদের ফ্যাসিবাদী বক্তব্যের পরও যাঁদের গাজা থেকে জোর করে তাড়ানো হয়েছিল বা ভুল প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরানো হয়েছিল, তাঁরা সাম্প্রতিক অস্ত্রবিরতির পর গাজায় ফিরেছেন। অবশ্য তাঁদের ঘরবাড়ি কিছুই অবশিষ্ট নেই। এই ৬০০ দিনের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধের সময় ইসরায়েল এমন এক ভয়ঙ্কর শক্তি প্রয়োগ করেছে, যা ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহৃত শক্তির তুলনায় অনেক বেশি।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১৫ টন বোমা ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ভিয়েতনাম যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল প্রায় ১৯ বছর। ওই যুদ্ধে ৯ লাখ ৬৬ হাজারের বেশি ভিয়েতনামের নাগরিক নিহত হয়েছিলেন। গাজায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েল প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৭৫ টন বোমা ফেলেছে, যা ভিয়েতনামের তুলনায় ১৮ গুণ বেশি।
ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১৫ টন বোমা ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ভিয়েতনাম যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল প্রায় ১৯ বছর। ওই যুদ্ধে ৯ লাখ ৬৬ হাজারের বেশি ভিয়েতনামের নাগরিক নিহত হয়েছিলেন। গাজায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েল প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৭৫ টন বোমা ফেলেছে, যা ভিয়েতনামের তুলনায় ১৮ গুণ বেশি।
ফিলিস্তিনিদের নিজেদের ভূমিতে থেকে যাওয়ার এবং প্রয়োজনে নিজেদের ভূমিতে মরার দৃঢ় সংকল্প এবং বিশ্বব্যাপী জনমত যেভাবে দ্রুত ইসরায়েলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে—এই দুটি বিষয় ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বুঝে রাখা দরকার, এই বৈশ্বিক সমর্থন এখন শুধু বামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেই নয়, মধ্যপন্থী ও ডানপন্থীদের মধ্যেও প্রবেশ করতে শুরু করেছে। গণহত্যার যৌক্তিক সমালোচনাকে ‘ইহুদিবিদ্বেষ’ বলে অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা আগের মতো আর কাজ করছে না। এ ‘রুপালি গুলি’ ইসরায়েল ইতিমধ্যেই খরচ করে ফেলেছে।
ইসরায়েল ফিলিস্তিনকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে গিয়ে তারা এখন পুরো পৃথিবীকে ফিলিস্তিন বানিয়ে ফেলেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজধানী ও শহরের রাস্তায় কোটি কোটি মানুষ এখন ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নেমে এসেছেন। গাজার মানুষকে অবরুদ্ধ করতে গিয়েও এখন জায়নবাদী শাসন নিজেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। এমনকি ইউভাল নোয়াহ হারারির মতো জায়নবাদী ইতিহাসবিদও এখন বলছেন, জায়নবাদের শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে।
ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে বর্বর গণহত্যা চালাচ্ছে। সেখানে তারা আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ অস্ত্র, গোলাবারুদ, বোমাসহ সব ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করছে। আন্তর্জাতিক মানবিক আইনে সুরক্ষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালেও নির্বিচার বোমা ফেলা হচ্ছে। তবুও ইসরায়েলি সরকার ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে ধ্বংস করার তাদের প্রধান লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি এবং পারবেও না।
ইসরায়েল কেবল অর্জন করতে পেরেছে যুদ্ধাপরাধ, জাতিগত নিধন, শিশু ও নারী হত্যা, অবকাঠামো ধ্বংস, গাজা উপত্যকার মানুষের জীবনের সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি জনগণ দেখাচ্ছেন ধৈর্য, প্রতিরোধ, দেশপ্রেম, মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং তাঁদের প্রতিরোধের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন।