ফ্যাসিস্টের দোসর সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দেশত্যাগ নিয়ে বেশ চাপে পড়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তিনি কিভাবে দেশ ত্যাগ করলেন তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। এরই মধ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য এসেছে যুগান্তরের হাতে।
সূত্র বলছে, গত ২৬ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের ডিএসবির পুলিশ সুপার এক গোপনীয় জরুরি বার্তায় রাজধানীর রাজারবাগে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) সদর দপ্তরে আবদুল হামিদসহ ৪৫ জনের একটি তালিকা পাঠিয়ে তাদের দেশত্যাগ ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন। ওই তালিকায় ৩৯ নম্বরে ছিল আবদুল হামিদের নাম। গোপনীয় ওই চিঠির স্মারক নম্বর ৪৫০। চিঠিতে বলা হয়, ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে কিশোরগঞ্জ জেলায় রুজু হওয়া গুরুত্বপূর্ণ মামলায় এসব আসামির বিদেশ গমনাগমন রোধের প্রয়োজনীয়তা আছে।
গত ১৪ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এক মামলায় আবদুল হামিদকে আসামি করার প্রেক্ষাপটে তার দেশত্যাগে এই নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এসবির ইমিগ্রেশন শাখায় এ-সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা অদ্যাবধি যায়নি। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ চিঠি দেওয়ার পর আবদুল হামিদের দেশত্যাগের কোনো সুযোগ থাকার কথা না। এ বিষয়ে জানতে শুক্রবার এসবি প্রধানসহ সিনিয়র কর্মকর্তাদের একাধিকবার ফোন করা হলেও রিসিভ করেননি।
এদিকে সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগের ঘটনায় ইতোমধ্যেই পুলিশের মাঠ পর্যায়ের চার কর্মকর্তাকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। একই সঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তর অতিরিক্ত আইজিপিকে (প্রশাসন) প্রধান করে তিন সদস্যের ইনকোয়ারি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি ইতিমধ্যে কার্যক্রমও শুরু করেছে।
অভিযোগ উঠেছে, দেশত্যাগের জন্য আবদুল হামিদ বিমানবন্দরে পৌঁছার পর সেখানে দায়িত্বরত তিনটি গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা গ্রিন সিগনাল দেন। এর আগে আবদুল হামিদের বিষয়ে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষই সর্বপ্রথম গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে অবগত করে। সংস্থাগুলোর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সিনিয়রদের জানানোর স্বল্পসময়ের মধ্যেই দেশত্যাগের গ্রিন সিগনাল দেওয়া হয়। এরপরই ছেলে ও শ্যালককে নিয়ে দেশত্যাগের চূড়ান্ত অনুমতি পান হামিদ। তবে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হলে পুলিশের মাঠ পর্যায়ে চার কর্মকর্তাকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। এ নিয়ে পুলিশের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
বিমানবন্দরে দায়িত্বে থাকা এসবির এক কর্মকতা বলেছেন, হামিদকে আটকানোর বিষয়ে পূর্ববর্তী কোনো নির্দেশনা ছিল না। এছাড়া ঘটনার রাতে চেইন অব কমান্ড অনুযায়ী স্টেপ বাই স্টেপ সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলেই সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমরা বুঝতে পারছি না আমাদের দোষ কোথায়।’
সূত্র বলছে, রাত সোয়া ১টার দিকে ইমিগ্রেশনে দায়িত্বরত এক এসপির কাছে বিমানবন্দরের ইডি ফোন করে বিষয়টি জানান। ওই এসপি জানান দায়িত্বরত অতিরিক্তি ডিআইজিকে। তিনি সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলে ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে আবদুল হামিদকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এর পরই সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়।
ওই রাতে বিমানবন্দরে দায়িত্বে থাকা এসবির এক কর্মকর্তা দাবি করেন, কিশোরগঞ্জের আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা তার দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে কোনো আবেদন করেছেন বলে তার জানা নেই। গত ৫ আগস্ট-পরবর্তী কিছু ফ্যাসিস্টের দোসর একইভাবে সিনিয়রদের নির্দেশে বিমানবন্দর পার হন বলেও জানান তিনি।
সার্বিক বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী যুগান্তরের কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। শুক্রবার রাতে ফোনে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘দোয়া করেন, ভালো থাকেন।’
তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর যুগান্তরকে বলেন, এ বিষয়ে একটি ইনকোয়ারি কমিটি করা হয়েছে। কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। এ ঘটনায় কার কী গাফিলতি আছে আরও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্তে মূল বিষয় বেরিয়ে আসবে। তিনি বলেন, দায় নিরূপণের জন্যই কমিটি করা হয়। এক্ষেত্রে যারযার সম্পৃক্ততা আসবে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনায় বুধবার দিবাগত রাত ৩টায় একটি জিডি করেন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) দায়িত্বরত ‘পালা ইনচার্জ’। জিডি নম্বর (০৮০৫২০২৫-এ-৭৩৮)। জিডিতে বলা হয়েছে, টিজি৩৪০ বিমানযোগে চিকিৎসার উদ্দেশে ব্যাংককগামী যাত্রী মো. আবদুল হামিদ, পাসপোর্ট নম্বর : ডি০০০১০০১৫ (সাবেক রাষ্ট্রপতি), ভিআইপি টার্মিনালে এলে টার্মিনাল ইনচার্জ ওসি ইমিগ্রেশন আলফা-১১ কে অবগত করে। আলফা-১১ এর কর্মকর্তা অপর দুটি গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বরত দুই কর্মকর্তাকে অবগত করেন। ওই দুই কর্মকর্তা হামিদের বিষয়ে অনাপত্তি প্রদান করেন। এই অনাপত্তি ওসি ইমিগ্রেশন আলফা-১১ এর কর্মকর্তা এসএস ইমিগ্রেশন (অপারেশন), অ্যাডিশনাল ডিআইজি ইমিগ্রেশন ও ডিআইজি ইমিগ্রেশনকে অবগত করেন। অ্যাডিশনাল ডিআইজি ইমিগ্রেশন এসবি চিফের রেফারেন্সে ওসি ইমিগ্রেশন আলফা-১১কে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন। ওসি ইমিগ্রেশন আলফা-১১ এসবির উল্লিখিত সিনিয়রদের নির্দেশে ও দুটি গোয়েন্দা শাখা থেকে প্রাপ্ত অনাপত্তি সাপেক্ষে এবং ইমিগ্রেশন ফরট্র্যাক সিস্টেমে আবদুল হামিদ সম্পর্কে কোনো বিরূপ মন্তব্য না থাকায় ভিআইপি টার্মিনালে কর্তব্যরত ইনচার্জকে ইমিগ্রেশন করার নির্দেশ দেন। টার্মিনাল ইনচার্জ ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করেন।
জিডিতে আরও বলা হয়, ‘উল্লেখ্য উক্ত যাত্রীর সাথে তার পুত্র রিয়াদ আহমেদ, পাসপোর্ট নম্বর : বি০০০৬৯৮৮০ ও তার শ্যালক ড. এএনএম নওশাদ খান, পাসপোর্ট নম্বর : এ০৭৯৫০৬৭১ গমন করেন।’
এদিকে আবদুল হামিদের দেশত্যাগের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে এসবির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাহসীনা আরিফকে প্রত্যাহার করে সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। এছাড়া এসবি এক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একই ঘটনায় কিশোরগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ হাছান চৌধুরীকে প্রত্যাহার ও আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে কিশোরগঞ্জের সদর থানায় দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
জানা গেছে, সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বিমানবন্দরের ভিভিআইপি টার্মিনালে পৌঁছার পর হযরত শাহ্?জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রধান নির্বাহী (ইডি) দায়িত্বরত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে বিষয়টি জানায়। পরে তাদের ক্লিয়ারেন্স পেয়ে দেশত্যাগ করেন আবদুল হামিদ। দেশত্যাগের আগে সার্বিক কার্যক্রম চলাকালে গাড়িতেই বসে ছিলেন হামিদ।
উল্লেখ্য, বুধবার দিবাগত রাত ৩টা ৫ মিনিটে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্ল্যাইটে দেশ ছাড়েন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। তিনি বিমানবন্দরে যান রাত ১১টার দিকে। প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সেরে রাত ৩টা ৫ মিনিটের দিকে থাই এয়ারওয়েজের টিজি-৩৪০ নম্বর ফ্ল্যাইটে থাইল্যান্ডের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, আবদুল হামিদের দেশত্যাগে কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকায় তাকে ‘চিকিৎসার জন্য’ যেতে দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় টানা দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন আবদুল হামিদ। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল প্রথম দফায় দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন। এরপর তিনি ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল দ্বিতীয়বার ২১তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন। তার মেয়াদ শেষে ২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন মো. সাহাবুদ্দিন। বঙ্গভবন ছাড়ার পর আবদুল হামিদ রাজধানীর নিকুঞ্জের বাসায় উঠেছিলেন। তবে ৫ আগস্টের পর তিনি ওই বাসায় আর ছিলেন না। এতদিন কোথায় ছিলেন, তা এখন পর্যন্ত জানা সম্ভব হয়নি।
জুলাই অভ্যুত্থানে হামলা ও গুলি করার ঘটনায় সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ ১২৪ জনের বিরুদ্ধে ১৪ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়। তবে তার দেশত্যাগে আদালতের নিষেধাজ্ঞা কিংবা কোনো বাহিনীর আপত্তি ছিল না বলে জানিয়েছে পুলিশ।