বগুড়া প্রতিনিধি: পুলিশের ছররা গুলিতে বগুড়ায় সিয়াম শুভ নামের এক কিশোরের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেলেও পুলিশের করা মামলায় ভিন্ন বয়ান দেয়া হয়েছে। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আন্দোলনকারীদের ছোড়া ককটেল বিস্ফোরণে আহত হয়ে সিয়াম শুভ নিহত হন।
তবে হাসপাতালের চিকিৎসক, নিহতের স্বজন ও স্থানীয় লোকজন জানান, পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন সিয়াম।
গত ২১ জুলাই সদর থানা পুলিশের উপপরিদর্শক মো. জাকির আল আহসান মামলাটি করেন। মামলায় বগুড়া জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ভিপি সাইফুলকে প্রধান আসামি করা হয়। ২ নম্বর আসামি করা হয় ওই এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর (৮ নম্বর) এরশাদুল বারীকে। এ ছাড়া মামলায় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠন এবং জামায়াতের মোট ৩৭ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত অনেককে আসামি করা হয়।
এর আগে ১৯ জুলাই বিকেলে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন সিয়াম শুভ। বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. আবু সালেহ। তিনি ওই দিন সিয়ামের মৃত্যুর প্রাথমিক কারণ হিসেবে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, একাধিক ছররা গুলি শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে প্রবেশ করায় সিয়ামের মৃত্যু হয়েছে।
সিয়ামকে শজিমেকের আগে নিয়ে যাওয়া হয় সেউজগাড়ী এলাকায় অবস্থিত বগুড়া নার্সিং হোম নামের ক্লিনিকে। ক্লিনিকের চেয়ারম্যান ডা. এ এইচ এম মুশিহুর রহমান ওই সময় বলেছিলেন, ‘সিয়ামকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় কয়েকজন আমার ক্লিনিকে নিয়ে আসে। তখন আমি পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে তাকে জীবিত পাইনি। অর্থৎ সে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করে।’ তিনি আরও জানিয়েছিলেন, সিয়ামের শরীরে অসংখ্য ছররা গুলির চিহ্ন পান তিনি। তার দুই চোখের ভেতরে গুলি ঢুকে মাথার ভেতরে চলে যায়।’
এদিকে, ২১ জুলাই পুলিশের করা মামলার এজাহারের একটি অংশে উল্লেখ করা হয়, ১ নম্বর আসামি ভিপি সাইফুল ও ২ নম্বর আসামি এরশাদুল বারী এরশাদের নেতৃত্বে ও মদদে হাতে লাঠি নিয়ে মামলার সব আসামি বেআইনি জনতায় দলবদ্ধ হয়ে অতর্কিতভাবে পুলিশের সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টিসহ কর্তব্যরত পুলিশকে লক্ষ্য করে বেপরোয়াভাবে বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ও বিস্ফোরক দ্রব্য ককটেল নিক্ষেপ করতে থাকে। মামলার ১৭ নম্বর আসামি থেকে ২৩ নম্বর আসামিরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এ সময় ১৮ নম্বর আসামি বগুড়া জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকী রিগ্যানের ছোড়া ককটেল বিস্ফোরণে মামলার বাদীসহ তিনজন পুলিশ আহত হন। পরে আসামিদের ধাওয়া করলে তারা পুনরায় পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ছুড়লে তাদের সঙ্গী সিয়ামের কপাল, মুখমণ্ডল, বুক, পেট, দুই হাত ও পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর জখম হয়। পরে স্থানীয় লোকজন সিয়ামকে উদ্ধার করে শজিমেক হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে মৃত ঘোষণা করেন।
সিয়ামের স্বজন ও প্রতিবেশী সূত্রে জানা গেছে, ৭ বছর আগে সিয়ামকে বগুড়া রেলওয়ে স্টেশনে কুড়িয়ে পান তার বর্তমান হাড্ডিপট্টি বস্তির বাসিন্দা শাপলা বেগম। পরে সিয়ামকে বাড়িতে নিয়ে আশিক-শাপলা দম্পতি সিয়ামকে লালন-পালন করেন।
সিয়ামের পালিত বাবা মো. আশিক বলেন, সিয়ামের আসল বাড়ি বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার কড়িরহাট গ্রামে। তার বাবার নাম বাবলু মিয়া। মায়ের নাম আয়েশা বেগম। তারা দুজনই মৃত। যখন সিয়ামকে কুড়িয়ে পাই তখন ওর বয়স ছিল ৯ বছর। সে আমাদের যেটুকু বলেছে সেটাই জানি। ছোটবেলায় কিছুদিন লেখাপড়া করেছে। আমাদের আরো দুই ছেলে দুই মেয়ে রয়েছে। তারা লেখাপড়া করে। আশিক বলেন, সিয়াম ভাংরি সংগ্রহের কাজ করতো।
সিয়ামের মৃত্যু সম্পর্কে আশিক বলেন, ‘সেদিন সে ভ্যান নিয়ে ভাংরি সংগ্রহে গিয়েছিল। পরে ভ্যান রেখে সেউজগাড়ীতে ভাত খেতে গিয়েছিল। ওই সময় সে গুলি খায়। সিয়ামকে বগুড়ার নামাজগড় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।’ এখন পর্যন্ত প্রশাসন থেকে কোনো খোঁজ-খবর বা সাহায্য-সহযোগিতা করা হয়নি বলে জানান তিনি।
মেডিকেলের মর্গ থেকে সিয়ামের লাশ নিতে গিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা মো. ফারুক হোসেন। তিনি বলেন, সিয়ামের মুখে এবং বুকে অজস্র ছররা গুলির চিহ্ন। মামলায় দেখলাম ককটেলের বিস্ফোরণের কথা বলা হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলা। পুলিশ গুলি করে হত্যা করে সেটা চাপিয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের ওপর।
সিয়ামের লাশ দেখেছেন তার প্রতিবেশী আমেনা বেগম। তিনি বলেন, সিয়ামের বুক, মুখ পুরোটাই ঝাঝরা ছিল।
মামলার আসামি বগুড়া জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকী রিগ্যান বলেন, মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলাম, ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এরশাদুল বারী এরশাদ ও যুবদলের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীরের হুকুমে আমার ছোড়া ককটেলের আঘাতে সিয়ামের মৃত্যু হয়েছে। সিয়াম নিহত হওয়ার ঘটনাটি দিনের বেলা রাস্তার উপরের ঘটনা। সেখানে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা ছিল। কার গুলিতে সে নিহত হয়েছে সেটা সবাই দেখেছে। সেটার ভিডিও ফুটেজ, চাক্ষুস সাক্ষী সবই আছে। ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করে আন্দোলন দমন করার জন্য স্বৈরাচারকে টিকিয়ে রাখার জন্য তারা এ মিথ্যা সাজিয়েছে।
জানতে চাইলে মামলার বাদী সদর থানার এসআই জাকির আল আহসান বলেন, মামলার কপি তার কাছে নেই। কাগজ না দেখে তিনি বলতে পারবেন না এজাহারে কী লেখা আছে। চিকিৎসকরা কী বলেছেন সেটাও বলতে পারবেন না তিনি।
এসআই বলেন, মামলাটি ডিবিতে দেয়া হয়েছে। তারা এটা নিয়ে কাজ করছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সম্পর্কেও তিনি জানেন না বলে জানান।
বগুড়া ডিবি পুলিশের ইনচার্জ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই মামলাগুলো নিষ্পত্তির জন্য একটা সিদ্ধান্ত প্রাথমিকভাবে হয়েছে। লিখিত চিঠি হয়তো পেয়ে যাব। এই মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বগুড়া পুলিশ সুপার জাকির হাসান জানান, মামলার বিষয়টি আবার তদন্ত করে দেখা হবে।