যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে দুই কয়েদির ফাঁসি আজ রাতে, অপেক্ষায় ৯৯ কয়েদি

শাহারুল ইসলাম ফারদিন, যশোর: চুয়াডাঙ্গার আলোচিত ধর্ষক ও খুনি কালু ও আজিজুলের ফাঁসি কার্যকরের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে যশোর কারা কর্তৃপক্ষ। সোমবার রাত পৌনে ১১টায় কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির মঞ্চে দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। ফাঁসি কার্যকরে প্রশিক্ষিত ৫ জল্লাদ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি হলেন চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার খাসকররা ইউনিয়নের রায় লক্ষীপুর গ্রামের মিন্টু ওরফে কালু ও একই গ্রামের আজিজ ওরফে আজিজুল। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হওয়ার পর তাদের ফাঁসি কার্যকরের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে যশোর কারা কর্তৃপক্ষ। শনিবার যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে শেষবারের মতো জনের স্বজনরা তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। বিচারিক ও আইনি প্রক্রিয়া শেষে এই ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে ভুক্তভোগী দুই পরিবারের টানা ১৮ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার তুহিন কান্তি খান। কারাগার সূত্র জানায়, আজিজুল এবং কালু আলমডাঙ্গার রায় রায়লক্ষীপুর গ্রামের দুই বান্ধবীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। এ ঘটনায় ২০০৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মামলা হয়। দীর্ঘ সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে চুয়াডাঙ্গার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ আদালতের বিচারক ২০০৭ সালের ২৬ জুলাই তাদের মৃত্যুদণ্ড এবং দুইজনকেই দুই লাখ টাকা করে জরিমানার আদেশ দেন। এরপর আসামিপক্ষ হাইকোর্টে আপিল করেন। ২০১২ সালে ১১ নভেম্বর নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখার আদেশ দেন হাইকোর্ট। আসামিপক্ষ মামলাটি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টেও যান। চলতি বছরের ২৬ জুলাই সেখানেও নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখার আদেশ হয়। পরে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়া হলেও তা নামঞ্জুর হয়। চলতি মাসের ৬ তারিখে কারা অধিদপ্তরকে চিঠি দেয় সুরক্ষা সেবা বিভাগ। যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার ৮ সেপ্টেম্বর সেই চিঠি গ্রহণ করে। জেলার তুহিন কান্তি খান বলেন, ফাঁসি কার্যকর করতে কেতু কামার, মশিয়ার রহমান, লিটু হোসেন ও আজিজুর রহমানসহ আট জল্লাদকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ফাঁসি কার্যকরের সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপার ও সিভিল সার্জনকে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামির অনুরোধে তাদের স্বজনদের সঙ্গে শেষ দেখাও সম্পন্ন হয়েছে। এসময় পরিবারের সদস্যরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। আলমডাঙ্গা উপজেলার জোড়গাছা গ্রামের ওই দুই বান্ধবকে ২০০৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রায়লক্ষীপুর গ্রামের মাঠে হত্যা করা হয়। হত্যার আগে তাদের দুজনকে ধর্ষণ করা হয় বলে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, গলায় গামছা পেচিয়ে শ্বাসরোধের পর মৃত্যু নিশ্চিত করতে গলাকাটা হয় ওই দুই নারীকে। এ ঘটনায় নিহতদের একজনের মেয়ে ঘটনার পর দিন আলমডাঙ্গা থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত ওই দুজনসহ চারজনকে আসামি করা হয়। অপর দুজন হলেন একই গ্রামের সুজন ও মহি। মামলা বিচারাধীন অবস্থায় মহি মারা যান। ২০০৭ সালের ২৬ জুলাই চুয়াডাঙ্গার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল সুজন, আজিজ ও মিন্টুকে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন। এরপর আসামিপক্ষের লোকজন হাইকোর্টে আপিল করেন। পরে ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানি শেষে হাইকোর্ট তা বহাল রাখেন। ২০১২ সালে ১১ নভেম্বর নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখার আদেশ দেন হাইকোর্ট। চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ দুই আসামির রায় বহাল রাখেন এবং অপর আসামি সুজনকে বেকসুর খালাস দেন। এ বছরের ২০ জুলাই যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান সুজন।

এদিকে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন কারাগার হচ্ছে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার। ১৮৭৫ সালে নির্মিত এই কারাগারে সব সময়ই বন্দী থাকে ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি আসামি। বর্তমানে সাজাপ্রাপ্ত বন্দী ও ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের পাশাপাশি শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ ১ হাজার ২১৭ জন বন্দী রয়েছে এই কেন্দ্রীয় কারাগারে। এছাড়া নানা অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ৯৯ জন আসামি কনডেম সেলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করে বেনজীর আহম্মেদ শিপন নামে এক কয়েদি ক্ষমা পেয়েছেন। কারাগারে ফাঁসি কার্যকর করতে কেতু কামার, মশিয়ার রহমান, লিটু হোসেন ও আজিজুর রহমানসহ অর্ধশতাধিক জল্লাদ কাজ করেছেন। যশোর কারাগারে প্রথম ফাঁসি কার্যকর করা হয় ১৯৭৭ সালের ১৬ অক্টোবর। এরপর যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে এক এক করে ৩৪ আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। কারাগারটিতে সোমবার রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে জোড়া ফাঁসি কার্যকরের মধ্যে দিয়ে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৩৬ জনে। এর আগে সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে জোড়া ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল এই কারাগারে। সর্বশেষ চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার দুর্লভপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার হোসেন ওরফে মনোয়ার মেম্বার হত্যাকাণ্ডের দায়ে দুই খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। দণ্ডপ্রাপ্ত দুজন হলেন- চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামের মৃত মুরাদ আলীর ছেলে আব্দুল মোকিম (৬০) ও মৃত আকছেদ আলীর ছেলে গোলাম রসুল ঝড়ু (৬২)। ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন নিজগ্রাম চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামে চরমপন্থী ক্যাডারদের হাতে খুন হন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মনোয়ার হোসেন। তিনি স্থানীয় কুমারী ইউনিয়ন পরিষদের দুই মেয়াদে ইউপি সদস্য ছিলেন। তাকে হত্যার ঘটনায় তার ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা অহিম উদ্দীন বাদী হয়ে আলমডাঙ্গা থানায় ২১ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। এই হত্যা মামলার এক যুগ পর ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে ঝড়ু ও মোকিমসহ তিনজনকে ফাঁসি ও দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। পরে উচ্চ আদালত ঝড়ু ও মোকিমের ফাঁসি বহাল রেখে বাকি সবাইকে খালাস দেন। এর আগে ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি জাসদ নেতা কাজী আরেফ আহমেদসহ দলটির পাঁচ নেতাকর্মীকে হত্যা মামলায় অভিযুক্ত তিন আসামির ফাঁসি কার্যকর করে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার। দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- কুষ্টিয়ার মিরপুরের রাজনগর গ্রামের হাবিবুর রহমান, কুর্শা গ্রামের আনোয়ার হোসেন ও রাশেদুল ইসলাম। ১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে কালিদাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে একটি সভা চলার সময় ব্রাশ ফায়ারে জাসদের পাঁচজন নেতা নিহত হন। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কাজী আরেফ আহমেদ ছাড়াও নিহত হন তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলা জাসদের সভাপতি লোকমান হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব আলী, স্থানীয় জাসদ নেতা ইসরায়েল হোসেন এবং শমসের মণ্ডল। এই হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পর ২০০৪ সালের ৩০ অগাস্ট ১০ জনের ফাঁসি এবং ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন কুষ্টিয়া জেলা জজ আদালত। তবে ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা হলে ২০০৮ সালের ৫ আগস্ট হাইকোর্ট ৯ জনের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন, একজনকে খালাস দেন ও ১২ জনের সাজা মওকুফ করেন। হত্যাকাণ্ডের প্রায় ১৭ বছর পর অভিযুক্ত তিন আসামির ফাঁসি কার্যকর হয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রীয় কারাগার যশোরে।