ডাকসু নির্বাচন: ভিপি পদে লড়া ৪৩ প্রার্থীর অধিকাংশই ‘আড়ালে’, আলোচনায় ৯ মুখ

Share

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে শেষমুহূর্তের প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত প্রার্থীরা। এ নির্বাচনে বেশি আলোচনায় ভিপি, জিএস, এজিএসসহ কয়েকটি পদ। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর কোন পদে কে যোগ্য, তা নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

ডাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে এবার বৈধ প্রার্থী ছিলেন ৪৪ জন। তবে বাগবিতণ্ডার জেরে রুমমেটকে ছুরিকাঘাত করায় একজন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। ফলে ভিপি পদে এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৩ জন। আগামী ৯ সেপ্টেম্বরের ভোটে ৪৩ জনের নামই থাকবে ব্যালট পেপারে।

ভিপি পদে ৪৩ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তাদের সবাইকে চেনেন না খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই। ক্যাম্পাসের উৎসবমুখর প্রচারণায় আলোচনা রয়েছেন হাতে গোনা কয়েকজন। ঘুরে-ফিরে তাদের নামই গণমাধ্যমে আসছে। টকশো থেকে শুরু করে সব অনুষ্ঠানেও ডাক পড়ছে আলোচিত কয়েকজনের।

ক্যাম্পাসে সশরীরে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচারণায় ভিপি পদে ১০ প্রার্থীর মুখ পরিচিত হয়ে উঠেছে। গণমাধ্যমের বিভিন্ন আয়োজনেও তাদের সরব উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে বেশি আলোচনায় ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের আবিদুল ইসলাম খান, ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের সাদিক কায়েম, বাগছাস সমর্থিত বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের আব্দুল কাদের, স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্যের উমামা ফাতেমা, বামজোটের প্যানেল প্রতিরোধ পর্ষদের শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি।

আলোচনায় রয়েছেন ছাত্র অধিকার পরিষদ সমর্থিত ডাকসু ফর চেঞ্জ প্যানেলের বিন ইয়ামীন মোল্লা, স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেন, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন সমর্থিত সচেতন শিক্ষার্থী সংসদের ইয়াছিন আরাফাত ও সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদের জামালুদ্দীন মুহাম্মাদ খালিদ।

ভিপি পদে লড়ছেন যে ৪৩ জন
মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে গত ২১ আগস্ট রাতে বৈধ প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করে ডাকসুর নির্বাচন কমিশন। তাতে ৪৪ জন প্রার্থীর নাম রয়েছে। নির্বাচনে বৈধপ্রার্থীদের নামের প্রথম বাংলা অক্ষর বিবেচনায় নিয়ে তালিকা ও ব্যালট নম্বর সাজানো হয়েছে।

তালিকায় সবার ওপরে রয়েছে আবদুল ওয়াহেদের নাম। তিনি স্বতন্ত্র ভিপিপ্রার্থী। ওয়াহেদ আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী। থাকেন সূর্যসেন হলে। তার ব্যালট নম্বর ১।

২ নম্বর ব্যালট পেয়েছেন আব্দুল কাদের। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ সমর্থিত বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ থেকে ভিপি পদে লড়ছেন তিনি। কাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। তিনি বিজয় একাত্তর হলে থাকেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে গণঅভ্যুত্থানে ভূমিকা রয়েছে কাদেরের।

উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলামও ভিপি পদে লড়ছেন। তার ব্যালটন নম্বর ৩। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী। থাকেন শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আল আমিন ইসলামও ভিপি পদে লড়ছেন। তিনি সূর্যসেন হলে থাকেন। নির্বাচনে তার ব্যালট নম্বর ৪। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভিপি পদে লড়ছেন আসিফ আনোয়ার অন্তিক। তিনি যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের শিক্ষার্থী। থাকেন মুহসীন হলে। তার ব্যালট নম্বর ৫।

স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য পরিষদের ভিপিপ্রার্থী উমামা ফাতেমা। তিনি প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। থাকেন সুফিয়া কামাল হলে। নির্বাচনে তার ব্যালট নম্বর ৬। উমামা ভিপি পদে নারীবান্ধব ক্যাম্পাস গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তার ভূমিকার কারণে এ ডাকসু নির্বাচনে আলোচিত ভিপি প্রার্থী তিনি।

৭ নম্বর ব্যালটের ভিপিপ্রার্থী ছাদেক হোসেন। তিনি ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী এবং থাকেন বিজয় একাত্তর হলে। ছাদেক স্বতন্ত্র প্রার্থী। ৮ নম্বর ব্যালটে নাম ছিল জালাল আহমদের (জ্বালাময়ী জালাল)। তবে তার প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে। ফলে তিনি আর প্রার্থী নেই। ব্যালট পেপারেও ৮ নম্বর প্রার্থীর নাম থাকবে না বলে জানিয়েছে ডাকসুর নির্বাচন কমিশন।

 

ব্যালট নম্বর ৯ ভিপিপ্রার্থী জাহিদ হাসানের। তিনি প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী। থাকেন ফজলুল হক হলে। ১০ নম্বর ব্যালট ভিপিপ্রার্থী তাহমিনা আক্তারের। তিনি দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী। দ্বীন মোহাম্মদ সোহাগ (আলাদীন) ভাষাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। তিনিও ভিপি পদে লড়ছেন। তার ব্যালট নম্বর ১১। থাকেন সূর্যসেন হলে।

স্বতন্ত্র প্রার্থী মারজিয়া হোসেন জামিলা ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী। থাকেন কবি সুফিয়া কামাল হলে। তার ব্যালট নম্বর ১২। মাহদী হাসানও স্বতন্ত্র প্রার্থী। ফলিত গণিত বিভাগের এ শিক্ষার্থী ফজলুল হক হলে থাকেন। ভিপি পদে তাকে ভোট দেওয়া যাবে ১৩ নম্বর ব্যালটে।

উর্দু বিভাগের মুহাম্মদ আবু তৈয়বও (হাবিলদার) ভিপি পদে প্রার্থী হয়েছেন। তিনি সলিমুল্লাহ হলে থাকেন। ব্যালট নম্বর ১৪। দেলোয়ার হোসেনের ভিপি পদে ব্যালট নম্বর ১৫। তিনি আরবি বিভাগের ছাত্র এবং থাকেন জসীম উদ্দীন হলে। ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের আজগর ব্যাপারীর ব্যালট নম্বর ১৬। অমর একুশে হলের আবাসিক ছাত্র তিনি।

সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদের ভিপিপ্রার্থী জামালুদ্দীন মুহাম্মদ খালিদ। আরবি বিভাগের এ শিক্ষার্থী থাকেন জসীম উদ্দীন হলে। তার ব্যালট নম্বর ১৭। ব্যবস্থাপনা বিভাগের শাফি রহমানও ভিপি হতে চান। তার ব্যালট নম্বর ১৮। থাকেন জিয়া হলে।

ছাত্র অধিকার পরিষদ সমর্থিত ডাকসু ফর চেঞ্জ প্যানেলের ভিপিপ্রার্থী বিন ইয়ামীন মোল্লা। তিনি লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী। থাকেন স্যার এফ রহমান হলে। তার ব্যালট নম্বর ১৯। ছাত্ররাজনীতি করায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দমন-পীড়নের শিকার হয়েছেন। জেলও খেটেছেন। ফলে তিনি এবারের নির্বাচনে আলোচিত প্রার্থীদের একজন।

ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থী আতাউর রহমান শিপন ভিপি প্রার্থী। তার ব্যালট নম্বর ২০। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান হলের আবাসিক ছাত্র।

২১ ও ২২ নম্বর ব্যালটে রয়েছেন ডাকসুর ভিপি পদে হেভিওয়েট দুই প্রার্থী। ২১ নম্বর ব্যালটে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের আবিদুল ইসলাম খান। তিনি ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী। থাকেন শেখ মুজিবুর রহমান হলে।

তার পরেই ২২ নম্বর ব্যালটে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের ভিপিপ্রার্থী আবু সাদিক (সাদিক কায়েম)। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। সাদিক কায়েমও শেখ মুজিবুর রহমান হলের ছাত্র।

ভিপি পদে ২৩ নম্বর ব্যালটের মালিক সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আবুল হোসাইন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান হলের ছাত্র। ইসলামী ছাত্র আন্দোলন সমর্থিত সচেতন শিক্ষার্থী সংসদের ভিপি প্রার্থী ইয়াছিন আরাফাত। ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ছাত্র তিনি। থাকেন শেখ মুজিবুর রহমান হলে। ভিপি পদে ২৪ নম্বর ব্যালটের মালিক। ২৫ নম্বর ব্যালটে স্বতন্ত্র প্রার্থী উজ্জল হোসেন। তিনি মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী এবং জিয়া হলে থাকেন।

ভিপি পদে ২৬ নম্বর ব্যালটটি ফাঁকা। এটি মূলত ছাত্রলীগের নেতা জুলিয়াস সিজারের নামে ছিল। তার তাকে অবৈধ প্রার্থী ঘোষণা করায় তার ব্যালটটি ফাঁকা রাখা হয়েছে।

অপারেজয়-৭১, অদম্য-২৪’ প্যানেল থেকে ভিপি পদে লড়ছেন যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের নাইম হাসান। তার ব্যালট নম্বর ২৭। নাইম বিজয় একাত্তর হলের ছাত্র।

ভিপি পদে ২৮ নম্বর ব্যালটে গণিত বিভাগের নাছিম উদ্দিন, ২৯ নম্বরে দর্শন বিভাগের ফয়সাল আহমেদ, ৩০ নম্বরে ইতিহাস বিভাগের মুদাব্বীর রহমান, ৩১ নম্বর ব্যালটে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের রাসেল মাহমুদ, ৩২ নম্বরে ইসলামিক স্টাডিজের সুজন হোসেন, ৩৩ নম্বরে একই বিভাগের সোহানুর রহমান, ৩৪ নম্বরে আইন বিভাগের হাবিবুল্লাহ, ৩৫ নম্বরে লোকপ্রশাসন বিভাগের হেলালুর রহমানের নাম রয়েছে।

‘সম্মিলিত ছাত্র ঐক্য’ প্যানেল থেকে ভিপি পদে লড়ছেন জান্নাতি বুলবুল। তিনি সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বেগম রোকেয়া হলের ছাত্রী। জান্নাতি বুলবুলের ব্যালট নম্বর ৩৬। ৩৭ নম্বর ব্যালটে রয়েছেন যায়েদ বিন ইকবাল। জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী তিনি।

ভিপি পদে ৩৮ নম্বর ব্যালটে রয়েছেন ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের রাকিবুল হাসান, ৩৯ নম্বরে ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের রাসেল হক, ৪০ নম্বরে মনোবিজ্ঞান বিভাগের রাহুল দেব রায়, ৪১ নম্বরে পরিসংখ্যা বিভাগের রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, ৪৩ নম্বরে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের শাহ্ জামাল সায়েম ও ৪৫ নম্বরে রয়েছেন ভাস্কর্য বিভাগের সুমিত সেন। সুমিত জগন্নাথ হলের শিক্ষার্থী।

বামজোটের প্যানেল প্রতিরোধ পর্ষদের ভিপি প্রার্থী শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি। তিনি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। থাকেন শামসুন নাহার হলে। তার ব্যালট নম্বর ৪৪। আর ৪২ নম্বর ব্যালট নিয়ে ভিপি পদে লড়ছেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শামীম হোসেন। শামীম বিজয় একাত্তর হলের শিক্ষার্থী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্প্রতি তার বিভিন্ন বক্তব্য-বিবৃতি ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক আলোচনায় আসেন।

আলোচিত প্রার্থীরাই জেতে, ‘গোল’ দিতে পারে যে কেউ!
বড় ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থক থাকায় সুনির্দিষ্ট ভোটব্যাংক রয়েছে। ফলে আলোচিত এবং বড় দলগুলোর সমর্থিত প্রার্থীরাই নির্বাচনে সবসময় জিতে আসে। তবে ব্যতিক্রমও আছে। নির্বাচনের মাঠ লেভেল প্লেয়িং হলে যে কেউ গোল দিতে পারে বলে মনে করছেন ডাকসুর সাবেক ভিপি ও জিএসরা।

ডাকসুর সাবেক জিএস ও বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য মুশতাক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবশ্যই প্রার্থীর যোগ্যতা ও আদর্শ দেখে ভোট দেন। আমার অভিজ্ঞতা অন্তত সেটাই বলে। তবে এবার পরিবেশ-পরিস্থিতি ভিন্ন। যদি শেষ পর্যন্ত সবার জন্য সমান সুযোগ থাকে, তাহলে স্বল্প পরিচিত কেউও বেরিয়ে আসতে পারে। কারণ অনেকগুলো দল থাকায় ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাবে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা যাকে একটু বেশি ভোট দেবে, তিনি জয়ী হয়ে যেতে পারেন। আবার নারী ভোট যেহেতু বেশি, ফলে নারী প্রার্থীদের দিকেও নজর থাকবে।’

কর্তৃপক্ষনির্ভর ডাকসু হওয়ায় ভোট নিয়ন্ত্রণের শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন সাবেক ভিপি ও নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাজনৈতিক কাঠামোয় এবার নির্বাচনটা হচ্ছে না। কর্তৃপক্ষনির্ভর নির্বাচন হচ্ছে। ভোট নিয়ন্ত্রণ করা হলে কর্তৃপক্ষের পছন্দের প্রার্থী বেরিয়ে আসতে পারে। আর যদি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হয়, শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে যায়, তাহলে অতি-উন্মাদনায় থাকা প্রার্থীও হেরে বসতে পারে।’

Read more