ইসির প্রস্তাবে একমত বিএনপি, পরিবর্তন চায় টিআইবি

Share

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালার খসড়ার ওপর ৪৩টি মতামত ও সুপারিশ নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা পড়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)সহ আটটি রাজনৈতিক দল, দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ৩৩ জন ব্যক্তি রয়েছেন। রয়েছেন বেশ কয়েকজন সাবেক আমলাও। জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বেশির ভাগ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে কোনো মতামত জানায়নি। গত ১০ জুলাই ওই খসড়ার ওপর মতামত জমা দেওয়ার সময় শেষ হয়েছে। গত ২৯ জুন এ খসড়া ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছিল ইসি। যদিও বিএনপি নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পর মতামত দিয়েছে। ইসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

আরও জানা গেছে, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালার খসড়ার বেশির ভাগ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে বিএনপি। তবে দলীয় প্রধানের পাশাপাশি মহাসচিবের হেলিকপ্টার বা আকাশযানে নির্বাচনি প্রচার চালানোর সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। নির্বাচনের সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই’র অপব্যবহারের বিষয়টি আচরণ বিধিমালায় যুক্তের কথা বলেছে দলটি।

অপরদিকে খসড়া আচরণ বিধিমালায় ব্যাপক পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি নির্বাচনে আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় কার্যক্রমে ব্যবহার নিষিদ্ধ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বনসহ বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে খসড়া বিধিমালায় কয়েকটি ধারা অস্পষ্ট বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। অন্যদের সুপারিশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার ও অপপ্রচার নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও সংগঠন থেকে পাওয়া সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করবেন তারা। এর মধ্যে গ্রহণযোগ্য কিছু সুপারিশ কমিশন আচরণ বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারে বলে ধারণা তাদের। তারা আরও জানান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনী খসড়া নিয়েও কাজ করছে কমিশন। আরপিও সংশোধনের ধরন অনুযায়ী বিধিমালায় পরিবর্তন আসার কথা রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, আরপিও সংশোধনের পর আচরণ বিধিমালা সংশোধন করা হয়। এএমএম নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন আরপিও সংশোধনের আগেই আচরণ বিধিমালার খসড়া প্রকাশ করেছে।

জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, আচরণ বিধিমালার ওপর যেসব মতামত এসেছে, সেগুলো অ্যাড্রেস করা লাগবে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা ওইসব মতামত কম্পাইল করে কমিশনে জমা দেবেন। আগামী কমিশন সভায় সেই মতামতগুলো পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আগামী সপ্তাহে কমিশন সভা হতে পারে। জানা গেছে, খসড়া আচরণ বিধিমালার ওপর যে ৪৩টি মতামত জমা পড়েছে তার মধ্যে আটটি রাজনৈতিক দলের। দলগুলো হচ্ছে-বিএনপি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ), ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ রক্ষণশীল দল, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ ও সম্মিলিত গণতান্ত্রিক দল। টিআইবি ও ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইইডি) নামের দুটি প্রতিষ্ঠানও মতামত জমা দিয়েছে। ব্যক্তিপর্যায়ের ৩৩ জনের মধ্যে সাবেক আমলা ও প্রবাসী বাংলাদেশিরা রয়েছেন।

রাজনৈতিক দলের মতামত : আরও জানা গেছে, বিএনপি প্রতিটি ধারা অনুযায়ী তাদের মতামত জানিয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রে একমত পোষণ করেছে। তবে সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সংজ্ঞায় ‘সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছে। নির্বাচনি প্রচারে সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটির স্থলে তিনটি ক্যাম্প করার সুযোগ দেওয়ার কথা বলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণাত্মক তথ্য, ভুল তথ্য, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই দিয়ে তৈরি কন্টেন্ট) এবং প্রার্থী ও দলীয় নেতাদের চেহারা বিকৃত করে তৈরি করা কন্টেন্ট প্রচার নিষিদ্ধের সুপারিশ করেছে। বিদেশ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার করা হলে বিটিআরসি’র মাধ্যমে তা প্রচার নিষিদ্ধের বিষয়টি যুক্ত করার জন্য বলেছে। গণমাধ্যমে সম্প্রচারিত নির্বাচনি ডায়ালগে যে দল যত সংখ্যক প্রার্থী দেবে, সেই অনুপাতে সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ’র প্রস্তাবে সশস্ত্র বাহিনীকে নির্বাচনে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে নিয়োগ দেওয়ার বিধান তৈরি করা, ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোট দিয়ে গন্তব্যে নিরাপদে ফিরে আসার বিষয়টি নিশ্চিত করা, নির্বাচনি কর্মকর্তা ও প্রার্থী সংশ্লিষ্ট সবাইকে আচরণ বিধিমালা মানতে বাধ্য করার বিধান তৈরির প্রস্তাব করেছে।

বিকল্পধারা বাংলাদেশ তার প্রস্তাবে ব্যানার তৈরিতে রেক্সিন বা পিভিসি ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। দলটি বিলবোর্ডে প্রচারের সুযোগ দেওয়ার ঘোর বিরোধিতা করেছে। এর যৌক্তিকতা হিসাবে দলটি বলেছে, একটি নির্বাচনি আসনে ১০ জন প্রার্থী থাকলে ২০টি করে মোট ২০০টি বিলবোর্ড হতে পারে। এতে ঝামেলা বাড়বে। বিত্তবান প্রার্থীরা এর সুযোগ বেশি নেবে। এতে নির্বাচনি ব্যয় বেড়ে যাবে। এছাড়া দলটি ভোটার ছাড়া কেউ যাতে ভোটকেন্দ্রের ভেতর ও আশপাশে ঘোরাঘুরি করতে না পারে, সেই বিধান আচরণ বিধিমালায় যুক্ত করার দাবি জানিয়েছে।

ব্যাপক সংশোধনীর প্রস্তাব টিআইবির : রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালায় ব্যাপক সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছে টিআইবি। একই সঙ্গে খসড়া আচরণ বিধিমালার বিভিন্ন বিষয় অস্পষ্ট থাকার বিষয়টিও তুলে ধরেছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নির্বাচন আয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য পৃথক আচরণ বিধিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। এর যৌক্তিকতায় টিআইবি বলেছে, বিগত কয়েকটি নির্বাচনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নির্বাচন আয়োজনের সঙ্গে জড়িতরা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি প্রচারণাসহ রাজনৈতিক কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে অংশ নিয়েছে। এছাড়া প্রার্থীদের হলফনামায় দেওয়া সম্পদ, ঋণ ও আয়-ব্যয়ের তথ্য যাচাইয়ে অটোমেশন পদ্ধতি প্রস্তুত করতে নির্বাচন কমিশনকে আহ্বান জানানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সমন্বয়ে ওই অটোমেশন পদ্ধতিতে হলফনামা যাচাই করার প্রস্তাব করেছে।

আচরণ বিধিমালায় সংশোধনীর বিষয়ে টিআইবির প্রস্তাবে সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সংজ্ঞায় প্রধান উপদেষ্টাকে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। খসড়া বিধিমালায় রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের নির্বাচনিী ও রাজনৈতিক অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এজন্য একটি নতুন ধারা যুক্তের প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি। ওই ধারায় রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আয়-ব্যয়ের তথ্য জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা, দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে মনোনয়ন না দেওয়া এবং নির্বাচিতদের সম্পদ ইসির ওয়েবসাইটে প্রকাশের বিধান যুক্তের কথা বলেছে। আচরণ বিধিমালার ধারা ১৩ তে একটি উপধারা যুক্ত করে সেখানে প্রচারণায় বেশ কিছু বিধি-নিষেধ আরোপের সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে নির্বাচনি প্রচার বন্ধ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা কনসার্ট, ধর্মীয় মাহফিল বা জমায়েত ইত্যাদির মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্বাচনি প্রচার না চালানোর নিয়ম অন্যতম।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারসংক্রান্ত নতুন ধারা বা উপধারা যুক্তের প্রস্তাব করেছে টিআইবি। এ বিষয়ে সংস্থাটির পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত নীতিমালায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির ব্যবহার বিষয়ে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে টিআইবি একগুচ্ছ সুপারিশ করেছে। সেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অপব্যবহারে প্রার্থী ও দলকে দায়ী করার বিধান যুক্তের কথা বলা হয়েছে। নির্বাচন-পূর্ব অনিয়মের ঘটনায় ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশের আগে তদন্ত শেষ করা এবং তদন্ত প্রতিবেদন ইসির ওয়েবসাইটে প্রকাশের বিধান যুক্তের প্রস্তাব করেছে। অনিয়মের ঘটনায় কোনো প্রার্থী বা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর কারও পদ বাতিল করা হলে, ওই ঘটনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও সুনির্দিষ্ট যুক্তিসংবলিত প্রতিবেদন ইসির ওয়েবাসইটে প্রকাশের বিধান খসড়া আচরণ বিধিমালায় যুক্তের প্রস্তাব করা হয়েছে।

Read more