বিদেশগমনে নিষেধাজ্ঞা থাকায় অবৈধ পথে দেশ ছাড়ার তৎপরতা চালাচ্ছেন মিঠু

ঢাকা অফিস:
যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের পর দেশে ফিরেই লাপাত্তা স্বাস্থ্যখাতের মাফিয়া মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। তাকে গ্রেপ্তারে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তৎপর থাকলেও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে ৪শ কোটি টাকার দুর্নীতিতে জড়িত এই মিঠু। তিনি কোথায় আছেন তা নিয়ে কৌতুহলের অন্ত নেই স্বাস্থ্যখাতে। কেউ বলছেন, মিঠু চম্পট দিয়েছে অন্য কোনো দেশে, কেউ বলছেন দেশেই আছেন তিনি।
মিঠুর অবস্থান জানতে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, দুদকসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। হাতে আসা তথ্য-উপাত্ত বলছে, মিঠু দেশেই আছেন। তিনি এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন। তার বিদেশগমনে নিষেধাজ্ঞা থাকায় অবৈধ পথে দেশ ছাড়ার তৎপরতা চালাচ্ছেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, মিঠুর অবস্থান শনাক্ত করা গেছে। তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যে কোনো সময় তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। এটি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

স্বাস্থ্যখাত জুড়ে দুর্নীতির ছাপ রাখা মিঠু গা ঢাকা দিলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাস্থ্যখাতে মিঠুর নিয়ন্ত্রণ বহাল রয়েছে। এখনও তার অনুগতরাই এ সেক্টরে প্রভাব বিস্তার করে আছেন।

অনিয়ম ও প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মিঠুর অপরাধের আমলনামা বেশ ভারি।

গোয়েন্দা তথ্য বলছে, নভেম্বর মাসে মিঠুর অবস্থান ছিল রংপুরে। তার বাড়িও রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর গ্রামে। সেখানে তিনি ৩দিন কাটিয়েছেন। এরপর রাজধানীতে এসে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে পৃথক স্থানে বৈঠক করেছেন। বিশেষ করে উত্তরা এলাকায় তিনি আস্তানা গেড়েছেন। উত্তরা, বনানী, গুলশান ও বাড়িধারা এলাকায় প্রায়ই মিঠু যাতায়াত করছেন। একই সঙ্গে অবৈধপথে দেশত্যাগের তৎপরতা চালাচ্ছেন বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।

দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মিঠুর অপরাধ তদন্তে এখনো কাজ করছে দুদক। দেশে থাকা মিঠুর কিছু সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। বর্তমানে মিঠুকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। যেকোন সময় মিঠু গ্রেপ্তার হবেন বলেও জানান তারা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্যমে মোতাজ্জেরুল ইসলাম (মিঠু) ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ও দেশের বাইরে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় ও সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে বিপুল অর্থ পাচার করে অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। উত্তরা, গুলশান, বানানীসহ রংপুরে রয়েছে তার বিলাসবহুল বাড়ি।

বনানীর ডিওএইচএস এলাকায় ৪/এ নং রোডে ৫ কাঠা জমি ও ৪/এ হোল্ডিং এ ৫তলা বাড়ী, উত্তরা ৬নং সেক্টরের ১০ নাম্বার রোডে ৪৬ নং হোল্ডিংয়ে ৪ তলা বাড়ি ও ৫.২৫ কাঠা জমি, এবং ৫নং সেক্টরের ৭ নাম্বার রোডে ১০নং হোল্ডিংয়ে ৬ তলা বাড়ি রয়েছে। বনানীর সি ব্লকের ৬নাম্বার রোডের ৮নং হোল্ডিংয়ের ১/৩/১ নং এর ১৮২৫ বর্গফুট ফ্লাট, গুলশান ৩৫ নাম্বার রোডের ৭/এ সুবাস্তু ফিরোজা ভিলা, এ্যাপার্টমেন্টে ৩৭২৫ বর্গফুট ফ্লাট ও ২টি কার পাকিং, দক্ষিণ কল্যাণপুর এলাকায় ১নং হোল্ডিয়ের এফ/৪ নাম্বারের ১৫৮৩ বর্গফুটের ফ্লাট, গুলশান প্রগতি স্বরনী এলাকার সুবাস্তু নজর ভ্যালি প্রজেক্টের ৩নং টাওয়ারের গ-২ হোল্ডিংয়ের ৬/সি এ্যাপার্টমেন্টে ৫৮৫ বর্গফুট ফ্লাট, উত্তরা ১৫সি সেক্টরের ২/সি রোডে ৩ কাঠার ২ টি প্লট রয়েছে। এছাড়াও টঙ্গি শিল্প এলাকায় ২ বিঘা জমি ও ভবন এবং রংপুরে কয়েক কোটি টাকার বাড়ি রয়েছে।

দুদকের বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, একুয়া কালচার ফার্ম লিমিটেড, জিএমজি এয়ারলাইন্স, নর্থ চিকস প্রা. লিমিটেড, ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কাশির উদ্দিন মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বায়ো মেডিকেল মার্সেন্ডিস প্রাঃ লিমিটেড এবং আইপিওনির হ্যাচারি প্রাঃ লিমিটেড নামীয় প্রতিষ্ঠানে শত কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে মিঠুর।

এছাড়াও এবি ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের একাউন্ট নং ৫৬২২৫(২) ও ৬৮২২৫(৩), ফ্রাগন সিকিউরিটি লিমিটেড একাউন্ট নং ৯৬৪৭(২), টোটাল কমিউনিকেশন লিমিটেড একাউন্ট নং ৯০৯৭(৫), এক্সিমইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড একাউন্ট নং ১১৭৩(৬), এমটিবি সিকিউরিটি লিমিটেড একাউন্ট নং ৬৭৪৫ সমুহে শত কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে মিঠুর। সাউথইস্ট ব্যাংক লি., এবি ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে শতকোটি টাকার সম্পদের তথ্যও পাওয়া গেছে। ঢাকা মেট্রো গ-৩৩-৫৪৯৮ ও ঢাকা মেট্রো গ -১৪-০৫৬৬ নম্বরের দুটি গাড়িও রয়েছে তার।

তথ্যসূত্র বলছে, দেশের সম্পদ বিক্রি করে দুবাই কিংবা মালেশিয়ায় ব্যবসার বিস্তারের পরিকল্পনা করছেন মিঠু। নানা কৌশলে দেশের অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে চলেছেন মোতাজ্জেরুল মিঠু। কেননা, সম্প্রতি মিঠুর ৫শ কোটি টাকার অবৈধ-বৈধ সম্পদ জব্দ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তাছাড়া বাংলাদেশেও তার ৭৪ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ হয়েছে। যেকোন সময় মিঠু সীমান্ত পেড়িয়ে দেশের বাইরে পালিয়ে যেতে পারেন বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।

গত ১৯ অক্টোবর দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারে জড়িত আলোচিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম ওরফে মিঠুর সম্পদ জব্দ ও বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে, সেই সংবাদ সম্মেলনের দুই মাস পেরিয়ে গেলেও মিঠু এখনও অধরা।

সূত্র বলছে, মিঠু ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ, ঢাকা ডেন্টাল হাসপাতালা, সি এম এস ডি, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল মৌলভীবাজার, জেনারেল হাসপাতাল গোপালগঞ্জ, আই এইচ টি সিলেট ও মুগদা জেনারেল হাসপাতালের ঠিকাদারির নামে ব্যপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন- যা দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে। এসব প্রতিষ্ঠানে সিন্ডিকেট করে অতি উচ্চমূল্য দেখিয়ে নিম্নমানের মালামাল সরবরাহ, দরপত্রের শর্তানুযায়ী মালামাল সরবরাহ না করা, কোন কোন ক্ষেত্রে মালামাল সরবরাহ না করেই বিল উত্তোলন, অপ্রয়োজনীয় এবং অযাচিত মালামাল সরবরাহ করার মত দুর্নীতি ও প্রতারণা করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি ৪০৪ কোটি ৯৭ লাখ ৬২ হাজার ৮৯৩ টাকা লুটপাট করেছেন।

তবে, এ টাকার বাইরেও মিঠু হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন- যার প্রমাণ এখনো দুদকের হাতে আসেনি বলে ধারণা তদন্ত সংশ্লিষ্টদের।

বর্তমানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর, নার্সিং অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ওষুধ প্রশাসন, সিএমএসডি, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এবং প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে এখনো রয়েছে মিঠুর সিন্ডিকেটের প্রভাব।

কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের উপপরিচালক (সিএমএসডি) ডা. তউহীদ আহমদ জানান, তিনি ৩ বছর ধরে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে নিযুক্ত। এই তিন বছরে মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে তার জানা নেই। এমনকি মিঠুর সঙ্গে তার কোনোদিন দেখা হয়নি বলে জানান।

জানা গেছে, এক সময় হাওয়া ভবনের দালাল ছিলেন মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার আমলে মিঠু সিন্ডিকেটের কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে মিঠু সিন্ডিকেট বেপরোয়া হয়ে ওঠে। স্বাস্থ্য খাতের মিঠু চক্র ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সরবরাহের কার্যাদেশ প্রাপ্ত হন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে মিঠু তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি করে স্বাস্থ্য খাতে নিজের রাজত্ব কায়েম করতে থাকেন। তথ্য রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কয়েকজন পরিচালক মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে কাজ করে। তাদের মাধ্যমেই মিঠু শত শত কোটি টাকা লুটপাটে করতে সক্ষম হন।

কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করে তা আত্মসাৎ করেন কোটি কোটি টাকা। আর যেসব প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রপাতি দিয়ে বিল নিতে হয়েছে, সেখানে দিয়েছেন ভুয়া স্টিকার লাগানো বিদেশি নামীদামী ব্রান্ডের যন্ত্রপাতি।

২০১৬ সালের ১০ মে বনানী থানায় দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক মিঠুর বিরুদ্ধে একটি ‘নন-সাবমিশন’ মামলা করেন। তবে, মামলা হওয়ার ৭বছর পার হলেও চার্জশীট দাখিল করতে পারেনি দুদক। ২০২০ সালে দুদকের সুপারিশের পরও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘কালো তালিকাভুক্ত’ হয়নি মিঠুর কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ওই তালিকায় ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির অনুসন্ধানে নেমে ২০২০ সালের ১ জুলাই মিঠুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ‘অতীব জরুরি তলবি নোটিস’ পাঠায় দুদক। তবে, মিঠু হাজির না হয়ে সেখানেও দুদককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেস।

এ বিষয়ে দুদুক কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ করে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে তারা বলেন, দুদক মিঠুকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যেই ভালো খবর আসতে পারে।