শিক্ষকদের কর্মসূচির কারণে দেশের অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলমান বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধ হয়ে গেছে। তিন দফা দাবি আদায়ে গতকাল বুধবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি শুরু করেছেন সহকারী শিক্ষকেরা। সারা দেশে অধিকাংশ বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এদিকে আগের রাতে হঠাত্ ডাকা এই কর্মসূচির খবর অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জানতে না পারায় গতকাল পরীক্ষা দিতে স্কুলে এসে বিপাকে পড়েন। তবে রাজধানী ও বিভাগীয় শহরগুলোর কিছু স্কুলে বিচ্ছিন্নভাবে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
তিন দফা দাবি আদায়ে ও কয়েক জন শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার প্রতিবাদে গতকাল সারা দেশে স্কুলে তালা দিয়ে উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের (এটিইও) কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করেন সহকারী শিক্ষকরা। এ কারণে গতকাল অসংখ্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। এর আগে দুই দিন কর্মবিরতি চললেও দেশের অনেক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা নেন। কিছু বিদ্যালয়ে পরীক্ষা নিতে সহযোগিতা করেন অভিভাবকরা।
‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের’ উদ্যোগে গত ২৭ নভেম্বর থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লাগাতার কর্মবিরতি চলছে। দাবি আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ায় গত মঙ্গলবার পরিষদের আহ্বায়ক মো. আবুল কাসেম, মোহাম্মদ শামছুদ্দিন মাসুদ, খাইরুন নাহার লিপি ও মু. মাহবুবুর রহমানসহ ২০২৩ ও ২০২৫ ব্যাচের কয়েক জন শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেওয়া হয়। এরপর রাতে শিক্ষকরা লাগাতার কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ অবস্থায় কার্যত থমকে গেছে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা। হঠাত্ স্কুল বন্ধ থাকায় ও বার্ষিক পরীক্ষা না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন অভিভাবকরা। তারা বলেন, বছরের এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কর্মবিরতি ও তালাবদ্ধ কর্মসূচিতে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে তাদের শিশু সন্তানেরা। পরীক্ষার সময় শাটডাউনে শিশুদের পড়াশোনায় বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটছে বলে তারা মনে করেন।
বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকে। রাশেদা বেগম নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘এভাবে হঠাত্ স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে ছোট ক্লাসের বাচ্চারা পড়াশোনা থেকে পুরোপুরি ছিটকে যায়। বাসায় তো তারা ঠিকভাবে পড়তে চায় না। শিক্ষকদের দাবি থাকতে পারে কিন্তু এভাবে বন্ধ হলে ক্ষতিটা কিন্তু আমাদের বাচ্চাদেরই হয়।’ জসীম উদ্দিন নামের আরেক অভিভাবক বলেন, ‘পরীক্ষা হচ্ছে না। যা নিয়ে আমাদের বাচ্চারাও দুশ্চিন্তায় আছে। সরকার আর শিক্ষকরা বসে সমস্যার দ্রুত সমাধান না করলে এই ক্ষতিপূরণ করা কঠিন হবে। আমরা চাই দুই পক্ষই আলাপ করে দ্রুত স্কুল খুলে দিক।’ এদিকে বরগুনার আমতলীতে আঙ্গুলকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ হয়ে স্কুলের তালা ভেঙেছেন। পরে স্কুলটিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্কুলে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
শিক্ষক নেতারা বলেন, তিন দফা দাবি বাস্তবায়নে আশ্বাস পাওয়া সত্ত্বেও ২২ দিনেও কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। যার কারণে গতকাল থেকে সারা দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা তালাবদ্ধ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। ঘোষণা অনুযায়ী, গতকাল থেকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সম্পূর্ণ বন্ধ থাকবে। শিক্ষকরা এ সময় বিদ্যালয়ে উপস্থিত হবেন না। নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করবেন। তবে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অবহিত করতে প্রথম দিন একজন করে শিক্ষক বিদ্যালয়ে গিয়ে বন্ধের বিষয়টি জানিয়ে দেন।
সহকারী শিক্ষকদের তিন দফা দাবিগুলো হলো: ১. বেতন স্কেল দশম গ্রেডে উন্নীত করা। ২. ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির জটিলতা দূর করা এবং ৩. সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি নিশ্চিত করা। তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় দশম গ্রেড দিতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানিয়ে আপাতত ১১তম গ্রেডের সুপারিশ করেছে। শিক্ষকরাও আপাতত সেই প্রতিশ্রুতির (১১তম গ্রেড দেওয়ার) বাস্তবায়ন দাবি জানিয়ে আসছেন।
প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের অন্যতম আহ্বায়ক মো. আনোয়ার উল্লাহ বলেন, ‘আমরা বাধ্য হয়েই শাটডাউনে গেছি। ২২ দিন ধরে অপেক্ষায় ছিলাম, কিন্তু কোনো বাস্তব পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। আমরা চাই সমস্যার দ্রুত সমাধান হোক, শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে ফিরুক, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা স্বাভাবিক হোক। কিন্তু সেই সুযোগ তৈরি করা এখন সরকারের দায়িত্ব।’
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) সূত্রে জানা গেছে, দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৫৬৯টি। এখানে ৩ লাখ ৮৪ হাজারের বেশি শিক্ষক কর্মরত। প্রধান শিক্ষকরা ইতিমধ্যে ১০ম গ্রেডে বেতনভুক্ত হলেও সহকারী শিক্ষকরা এখনো ১৩তম গ্রেডে আছেন।
প্রসঙ্গত, সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আন্দোলনরত সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কর্মবিরতি স্থগিত করে শ্রেণিকক্ষে ফিরেছেন। এতে গতকাল সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে