মাধঘোপা নিউজ ডেক্স: দুজন দুই ভূখণ্ডের মানুষ। জাতিতেও ভিন্ন। চেহারা-ছবিতেও মিল নেই কোনো। কারো সঙ্গে কারো কখনো দেখা হয়েছে কি না, তা অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু অদ্ভুত মিল রয়েছে দুজনের কুকীর্তিতে। পরিণতিও হয়েছে একই রকম।
একজন নমুনা পরীক্ষা না করেই করোনাভাইরাসের ভুয়া প্রতিবেদনের কারবারি বাংলাদেশের মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম। অন্যজন সম্প্রতি কলকাতার টক অব দ্য কান্ট্রি করোনার ভুয়া টিকা-কাণ্ডের মূল হোতা দেবাঞ্জন দেব। সব ঠিকঠাকই চালাচ্ছিলেন দেব। দুর্ঘট বাঁধল তৃণমূলের সংসদ সদস্য (বিধায়ক) অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তীকে টিকা দিয়ে। হাতেনাতে ধরা যাকে বলে। করোনা প্রতিষেধকের বদলে মূত্রে সংক্রমণের অ্যান্টিবায়োটিক পুশ করা হয় মিমির শিরায়। ঘটনা জানাজানি হলে দেবাঞ্জনকে কবজা করে পুলিশ।
সাহেদের চালচলনের কথা কি ভুলে গেছেন? সাংবাদিকতার স-ও যার চর্চায় ছিল না, সেই তিনি বনে যান মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। কী মুখরাই না ছিলেন তিনি! টিভি পর্দায় তার সেই টকশোর ভিডিওগুলো তোলা আছে। এখনো ইউটিউবে ঘুরে বেড়ায়। বিভিন্ন স্থানে নিজের সুবিধাজনক পরিচয় দিতেন সাহেদ করিম। কখনো সরকারি আমলা, সামরিক কর্মকর্তা; রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী-নেতাদের ঘনিষ্ঠ বলেও পরিচয় দিতেন। বোঝাতেন তিনিও কতটা প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান!
কলকাতার ধূর্ত দেবাঞ্জন দেবও ছিলেন একই রকম বর্ণচোরা। কলকাতা পুলিশের তদন্ত বলছে, নিজেকে একজন আইএএস কর্মকর্তা ও কলকাতা পৌর করপোরেশনের যুগ্ম কমিশনার হিসেবে পরিচয় দিতেন তিনি। সেই প্রভাবেই চালাতেন ভুয়া টিকাদান কেন্দ্র। সরকারি স্টিকার লাগানো গাড়ি হাঁকাতেন। সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীও পুষতেন প্রতারক দেব।
সাহেদের আরেকটি গুণ অবিকল পেয়েছেন যোজন দূরের দেবাঞ্জন। শুনলে অবাক হবেন, মানুষের স্বভাব কী করে মিলে যায় এমন? সেলফি আর ছবি তোলার বড় নেশা ছিল সাহেদের। একপর্যায়ে যেন তা পেশাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে বেছে বেছে অতি পরিচিত মুখ ও প্রভাবশালী মানুষের সঙ্গে তুলতেন ছবি। মন্ত্রী, এমপি, শীর্ষ রাজনীতিক, উচ্চপদস্থ পুলিশ-প্রশাসন কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব- কার সঙ্গে ছবি তোলেননি সাহেদ? ফেসবুক, টুইটারে নিজেই পোস্ট করতেন ছবিগুলো। বন্ধু-পরিচিত মহলকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন, কতটা ক্ষমতাবান তিনি। এসব ছবিই ছিল তার প্রতারণার পুঁজি।
হবহু স্বভাবের দেবাঞ্জন দেবও প্রতারণার কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মন্ত্রী, নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে তার ছবিকে। তার সঙ্গে দেখা গেছে রাজ্যের একাধিক মন্ত্রী ও তৃণমূলের নেতা-নেত্রীর ছবি। টুইটার থেকেই এসব ছবি মিলেছে। দেবাঞ্জন নিজে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের এসব ছবি টুইট করেন। ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়সহ একাধিক তৃণমূল নেতা ও মন্ত্রীর সঙ্গে তার ছবি আছে। দেবাঞ্জনের সঙ্গে ছবি রয়েছে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সর্বভারতীয় সভাপতি শান্তনু সেনের। পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মন্ত্রী তাপস রায় ও জোড়াসাঁকোর বিধায়ক স্মিতা বক্সির সঙ্গেও ছবি আছে দেবের। এ নিয়ে কলকাতার রাজনীতিতে কাদা ছোড়াছুড়িও চলছে বেশ। যাদের সঙ্গে ছবি এসেছে তাদের অনেকেই থানায় অভিযোগ দিয়েছেন চতুর দেবের বিরুদ্ধে।
সাহেদ করিম গ্রেপ্তারের আগে কেউ বুঝতে পারেনি কিছু। অনুমানও করেনি কেউ, রিসেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান পদকে সাইনবোর্ড করে কত অপকর্ম করে যাচ্ছেন তিনি। করোনার পরীক্ষা না করেই ভুয়া প্রতিবেদন-কাণ্ড প্রকাশ্যে এলে সবাই যেন নড়েচড়ে বসে। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার মতো একে একে বেরিয়ে আসে নানা অপকর্মের ফিরিস্তি। করোনা পরীক্ষার ভুয়া প্রতিবেদনের মামলায় গত বছরের ২০ জুলাই র্যাব তাকে কবজা করে। তারপরই জানা যায় তার অপকর্মের নানা তথ্য।
করোনা রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসার নাম করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, সাধারণ মানুষের অর্থ আত্মসাৎ, চাকরি-ব্যবসার নামে প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি, ব্যাংক ঋণ নিতে গিয়ে নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা পরিচয় দেওয়ার মতো দুঃসাহসও দেখিয়েছিলেন সাহেদ। তিনি আগেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগে কারাভোগ করেছিলেন। গত বছর গ্রেপ্তারর পর অস্ত্র, দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে প্রায় ৪৪টি মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। এসবের দায় কাঁধে নিয়ে কারাগারেই দিন কাটাচ্ছেন কপট প্রভাবশালী সাহেদ।
একই দশা দেবাঞ্জন দেবের। হেন কোনো প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি নেই যার সঙ্গে যুক্ত নন তিনি। কলকাতা পৌর করপোরেশনের বিশেষ কমিশনার তাপস চৌধুরীর সই জাল করে তিনটি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন দেবাঞ্জন । এ সময় তিনি পৌর করপোরেশনের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। করোনা মহামারিতে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পিপিই, করোনা পরীক্ষার কিট, পাল্স অক্সিমিটার, মাস্ক, স্যানিটাইজার বরাদ্দ নিয়েছিলেন দেবাঞ্জন। এগুলো কোথায়, কাদের দিয়েছিলেন সেই হদিস নেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূলের বিধায়ক লাভলি মৈত্রও। অভিযোগে বলেছেন, ভুয়া টিকা দিয়ে বহু মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন দেবাঞ্জন।
ভয়াবহ আর্থিক অনিয়মের অভিযোগও গলায় ঝুলছে দেবের। কোটা টাকা আর্থিক প্রতারণার অভিযোগে কলকাতার কসবা থানায় অভিযোগ করেছেন দুই ব্যবসায়ী। এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে ৯০ লক্ষ টাকা, আরেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে ২৬ লক্ষ টাকার প্রতারণার অভিযোগ জমা পড়েছে। এ ছাড়া দেবাঞ্জনের বিরুদ্ধে সরকারি চাকরির ভুয়া নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ দায়ের করেছেন অবসরপ্রাপ্ত এক বিএসএফ অফিসার। অভিযোগ, দেশটির স্বরাষ্ট্র ও পার্বত্যবিষয়ক দপ্তরের নামে বিজ্ঞপ্তি দেন দেবাঞ্জন। নিজের নিরাপত্তায় ওই অবসরপ্রাপ্ত বিএসএফ অফিসারকে নিয়োগ করেন। নবান্নের প্যাড জাল করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
কীভাবে বেরিয়ে এল দেবাঞ্জনের কারসাজি
গত ২২ জুন কলকাতার কসবায় একটি কেন্দ্রে করোনার টিকা নিতে গিয়েছিলেন তৃণমূলের সংসদ সদস্য ও অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী। টিকা দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু ওই সময় কোনো সনদ পাননি তিনি। সনদ চাইলে বলা হয়েছিল, মুঠোফোনে পাঠানো হবে সনদ। অপেক্ষায় ছিলেন মিমি। সনদ আর আসেনি। পরে তার সন্দেহ হয়। জানান পুলিশকে। অভিযোগ খতিয়ে দেখে পুলিশ আর দেরি করেনি। আটক করেন টিকাদান কেন্দ্রের পরিচালক দেবাঞ্জন দেবকে।
বিস্ময়কর হলেও সত্য করোনার টিকার নামে অ্যান্টিবায়োটিক মানবশরীরে ঢুকিয়ে দিচ্ছিলেন দেবাঞ্জন। এই অ্যান্টিবায়োটিক যকৃৎ ও স্নায়ুর মারাত্মক ক্ষতি করে। ডায়াবেটিক রোগীদের কিডনি বিকল করে দিতে পারে। সাধারণত এই ওষুধ ব্যবহার হয় মূত্র সংক্রমণ সারাতে।
পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ জানায়, দেবাঞ্জন কলকাতার পাইকারি ওষুধের বাজার বড়বাজারের বাগরি মার্কেটের এক ওষুধ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন কিনেছিলেন। পরে লেবেল পরিবর্তন করে করোনার টিকা কোভিশিল্ড, কোভ্যাকসিন ও স্পুতনিক-ভির লেবেল লাগিয়ে নেন। এসব ভুয়া টিকা ব্যবহার করা হতো তার টিকাদান কেন্দ্রে। তিনি কসবার টিকাকেন্দ্রে গত ১০ দিনে বিনা মূল্যে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে করোনার ভুয়া টিকা দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, শুধু কসবায় নয়, কলকাতার সিটি কলেজেও টিকাদান কেন্দ্র খুলে কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদেরও ভুয়া টিকা দিয়েছেন তিনি। এমনকি নিজের প্রতিষ্ঠানের কর্মীদেরও তিনি এ ভুয়া টিকা দিয়েছেন।
দেবাঞ্জনকে গ্রেপ্তারের পর একে একে তার সহযোগীদেরও ধরেছে পুলিশ। তদন্ত চলছে। হয়তো চোখ ছানাবড়া হওয়ার মতো আরও তথ্য বেরিয়ে আসবে। কিন্তু দেবাঞ্জন-কাণ্ডের যে তাপ পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে লেগেছে, তা কতটা পোড়ায় সংশ্লিষ্টদের, সেটিই দেখার বিষয়।