স্বেচ্ছাসেবক নামধারী ১২৫ দালালের কাছে জিম্মি রোগী ও রোগীর স্বজনেরা যশোর জেনারেল হাসপাতালে!

যশোর প্রতিনিধি 
বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের স্বেচ্ছাসেব নামধারী বিনা বেতনের কর্মচারী। দায়িত্ব না থাকলেও তাদের অধিকাংশকে হাসপাতালে দেখা মেলে। তারা কার্ড ঝুলিয়ে গোটা হাসপাতাল দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। হাসপাতালের কর্মচারী উল্লেখ করে ভুল বুঝিয়ে রোগীকে ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। তারা দাবিকৃত টাকা ছাড়া কাজ করেন না ওয়ার্ড ও বহির্বিভাগে। তাদের দাপটে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে নিয়োগ বোর্ড গঠন করে ৪৪ বহিরাগতকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়। বর্তমানে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৫ জনে। খাতা কলমে ৯৫ জনের নাম থাকলেও হাসপাতালে ডিউটি করছেন ১২০ জনের মতো। প্রশ্ন উঠেছে তালিকায় নাম না থাকার পরও স্বেচ্ছাসেবীর নামে যারা হাসপাতাল চষে বেড়াচ্ছেন এরা কারা। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে চমকপ্রদ কিছু শব্দ। কেউ কেউ বলছেন তারা ‘স্পেশাল কর্মচারী’ হিসেবে পরিচিত। এসব স্বেচ্ছাসেবী বেতন না পেলেও উল্টো হাসপাতালের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রতিমাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা প্রদান করেন। আর হাসপাতালের আইডি কার্ড পেতে তারা খরচ করেছেন জনপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা।
হাসপাতালের অপারেশন কক্ষে কথা হয় তামিম হোসেন নামে এক যুবকের সাথে। তিনি দাবি করেন, গত চার-পাঁচ মাস ধরে হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন। জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতার সুপারিশে হাসপাতালের জমাদ্দার ইমরান হোসেনকে জানিয়ে ডিউটি করছেন তিনি। রোগীর স্বজনেরা ‘খুশি’ হয়ে যা দেয় তাতেই তিনি খুশি।
শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে তারক দাস নামে এক যুবক ডিউটি করছেন। তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনাকালে হাসপাতালে কাজ করতেন। বর্তমানে এই ওয়ার্ডে বয় হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। যদিও হাজিরা খাতায় তার নাম নেই। হাসপাতাল প্রশাসন তাকে মৌখিকভাবে দায়িত্ব পালন করার অনুমতি দিয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি।
হাসপাতালে ‘বকশিস’ বাণিজ্যের শীর্ষে থাকা মোছাব্বের হোসেন ব্যস্ত সময় পার করেন রোগীর প্লাস্টার করার কাজে। তার পরিচয় জানতে চাইলে বলা হয়, হাসপাতালের কোনো খাতায় তার নাম নেই। তিনি বহিরাগত। একজন আবাসিক মেডিকেল অফিসার-আরএমও’র ভাতিজা তিনি। ওই আরএমও’র মৌখিক আদেশে কাজ করছেন মোছাব্বের।
সব পরিসংখ্যানকে হার মানিয়েছে করোনারি কেয়ার ইউনিট। এখানে ১৪ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। কথা হয় প্রসেনজিৎ দাস নামে একজন কথিত স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে। তিনি জানান, এ ওয়ার্ডে দায়িত্বরত এক ওয়ার্ডবয় মারা গেছেন। তার পরিবর্তে তিনি এখানে ডিউটি করছেন। একজন ডাক্তার তাকে এখানে কাজ করার অনুমতি দিয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি।
হাসপাতালের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, শুধু এই চার বিভাগই নয়, হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ ও সকল ওয়ার্ডে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ব্যক্তিগত লোক নিয়োগ দেয়া আছে। বিভিন্ন মহলের সুপারিশ থেকে হাসপাতালে কাজের সুযোগ পেয়েছেন এসব বহিরাগত। সুপারিশকারীরা আর্থিক সুবিধা নিয়ে বহিরাগতদের কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দেন। স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে হাসপাতালে ঢুকে মূলত প্রতারণাই শুরু করেন তারা। আর তাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে যশোর জেনারেল হাসপাতাল সুনাম হারাচ্ছে।
একাধিক রোগী অভিযোগ করেন, হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ড ও অস্ত্রোপচার কক্ষে ছেলে সন্তান হলে এক হাজার ও মেয়ে সন্তান হলে ৫০০ টাকা আদায় করা হয়। আবার বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগীর ক্যাথেটার লাগাতে টাকা, খুলতে টাকা, ট্রলি ঠেলতে টাকা, ড্রেসিং করতেও টাকা আদায় করেন তারা। এছাড়া বিষপান করে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসা রোগীদের পেট পরিষ্কার, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে ছাড়পত্র দেয়া পর্যন্ত সকল পর্যায়েই ইচ্ছেমত টাকা হাতিয়ে নেন এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা। বেতন নেই অজুহাতে রোগী ও তাদের স্বজনদের জিম্মি করে প্রকাশ্যে টাকা হাতাচ্ছে স্বেচ্ছাসেবকরা।
মনোয়ারা খাতুন নামে একজন দাবি করেছেন, তিনি হাসপাতালে ২৫ বছর স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছেন। ২৫ এপ্রিল শারীরিক অসুস্থতার কারণে ডিউটিতে আসতে দেরি হয়। এই অজুহাতে জমাদ্দার ইমরান হোসেন তাকে বরখাস্ত করেছেন। মনোয়ারা পুনরায় কাজের জন্য গেলে তার কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করা হয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীর। তিনি হাসপাতালের তত্ত্ববধায়কের কাছে লিখিত অভিযোগ দেবেন বলেও জানান। মৌখিক আদেশে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ ও মনোয়ারা খাতুনের কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবির বিষয়ে জমাদ্দার ইমরান হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে হাসপাতালে গেলে তার কক্ষটি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়।
রাজস্ব খাতের একাধিক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, কর্মচারী সংকট দেখিয়ে ওই ৯৫ জনকে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। অথচ সরকারি এই স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে ১০২ জন রাজস্ব ও ১৫৩ কর্মচারী উন্নয়ন খাতে কর্মরত রয়েছেন। এখানে কর্মচারী সংকট নেই। বাড়তি আয়ের জন্যই স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হারুন অর রশিদ জানান, স্বেচ্ছাসেবক কর্মচারীদের প্রতারণার বিষয়টি তিনি জেনেছেন। যারা অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে যারা বিভিন্ন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মৌখিক আদেশে কাজ করছেন তারা সকলেই অবৈধ। এখানে কাজ করতে হলে অবশ্যই নিয়োগের মাধ্যমে আসতে হবে বলেও মন্তব্য করেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাক্তার আবুল বাশার খুরশিদ আলম সাহেবের সাথে মুঠো ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করার পরেও ফোন রিসিভ না করাই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।