শিগগিরই বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা পরিধান করতে যাচ্ছেন নতুন রঙের নতুন পোশাক। পুলিশের এই পোশাক পরিবর্তনের উদ্যোগ ইতোমধ্যেই বাস্তবায়নের পথে। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সম্প্রতি এক চিঠির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোকে কেন্দ্রীয় রাজারবাগ পোশাক ভান্ডার থেকে নতুন পোশাকসামগ্রী গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তবে পুলিশের নতুন পোশাকের রং নিয়ে বাহিনীর অভ্যন্তরেই দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেক সদস্যের মতে, নতুন পোশাকের রং আসলে ‘রুচির দুর্ভিক্ষের প্রতিচ্ছবি’!
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের পাশাপাশি পোশাক পরিবর্তনের দাবি ওঠে। সেই ধারাবাহিকতায় পুলিশ, র্যাব ও আনসারের নতুন পোশাকের রং নির্ধারণ করা হয়। পুলিশের পোশাক হবে লোহার (আয়রন) রঙের, র্যাবের জলপাই (অলিভ) রঙের, আর আনসারের সোনালি গম (গোল্ডেন হুইট) রঙের।
সদর দপ্তরের নির্দেশনা
গত ২৮ অক্টোবর পুলিশ সদর দপ্তরের অ্যাডিশনাল ডিআইজি (লজিস্টিক) সারোওয়ার জাহান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, নতুন পোশাকসামগ্রী ও মালামাল বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আগামী ২ নভেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোকে সরকারি গাড়িযোগে রাজারবাগ পোশাক ভান্ডার থেকে সামগ্রী সংগ্রহের অনুরোধ জানানো হয়।
এ ছাড়া জানা যায়, নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট রেঞ্জে কাপড় সংগ্রহের পর নির্ধারিত স্থানে নতুন পোশাক তৈরির কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
মাঠ পর্যায়ের প্রতিক্রিয়া
২৯ অক্টোবর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশসহ বিভিন্ন জেলার একাধিক কর্মকর্তা ও কনস্টেবলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধিকাংশ পুলিশ সদস্য নতুন পোশাকের রংকে ‘অরুচিকর ও বেমানান’ বলে মনে করছেন। তবে চাকরির নিয়মের কারণে কেউই প্রকাশ্যে পরিচয় দিতে রাজি নন।
নরসিংদীতে কর্মরত এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “এই রং একেবারেই রুচির দুর্ভিক্ষ। যদি ডিআইজি বা এসপিদের মতামত নেওয়া হতো, কেউই এই রংকে সমর্থন করতেন না।”
গাজীপুর মেট্রোপলিটনের এক কর্মকর্তা বলেন, “এই নতুন রং একেবারেই বেমানান। আমার থানার এক পুলিশও এই রঙের প্রশংসা করেনি।”
ঢাকার একটি থানার কর্মকর্তার ভাষায়, “জোর করে এই বেমানান রং চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের যেকোনো দেশের পুলিশের পোশাকের রং দেখলেও আরও মানানসই বিকল্প পাওয়া যেত।”
রাজারবাগ পুলিশ ফোর্সের এক কর্মকর্তা বলেন, “পুরো রাজারবাগে ১০ জন সদস্যও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ, যারা এই রং পছন্দ করেছেন।”
পুলিশের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, “সরকার চাইলে রেঞ্জ পর্যায়ের সদস্যদের মতামত নিতে পারতো। তাহলে বর্তমান রঙের পক্ষে একটি ভোটও পড়তো না।”
ঢাকা রেলওয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তার মন্তব্য, “এই রঙে আমাদের পোশাক এখন বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীদের মতো দেখাচ্ছে। কে বা কারা রং চূড়ান্ত করেছে, বুঝে উঠতে পারছি না। আর একটু কালো গায়ের রঙের সদস্যরা এটা পরে দাঁড়ালে তো দেখা যাবে না!”
সরকারের ব্যাখ্যা
চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পুলিশ সংস্কার ও মানসিকতার পরিবর্তনের অংশ হিসেবে পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তিনি জানান, পুলিশের নতুন পোশাক হবে লোহার (আয়রন) রঙের, র্যাবের জলপাই (অলিভ) রঙের, আর আনসারের সোনালি গম (গোল্ডেন হুইট) রঙের।
পোশাক নির্ধারণ কমিটি
পুলিশ সদর দপ্তর পোশাক ও লোগো পরিবর্তনের জন্য ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। উন্নত বিশ্বের ১০–১৫টি দেশের পুলিশের ইউনিফর্ম বিশ্লেষণ করে ১৮ ধরনের পোশাক ট্রায়াল দেওয়া হয়। পরে পাঁচটি রং বাছাই করে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে গোপন ভোটের মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হয়।
নতুন পোশাকের পাশাপাশি পুলিশের নতুন লোগোতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। লোগোতে নৌকার পরিবর্তে থাকবে শাপলা, ধান ও গমের শীষ।
সদর দপ্তরের সর্বশেষ বক্তব্য
৩০ অক্টোবর পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন জানান, বর্তমানে জেলা পুলিশ ও মেট্রোপলিটন পুলিশের ইউনিফর্মের রং ভিন্ন। নতুন ইউনিফর্ম হবে সবার জন্য এক রঙের। ১৫ নভেম্বর থেকে ডিএমপি ও অন্যান্য মেট্রোপলিটন ইউনিটে নতুন পোশাক চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জেলা পর্যায়ে কিছুটা সময় লাগবে।
র্যাব ও আনসারের অবস্থা
র্যাবের নতুন ইউনিফর্ম সম্পর্কে জানতে চাইলে বাহিনীর লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেখাব চৌধুরী বলেন, “জানুয়ারিতে মন্ত্রণালয়ে র্যাবের নতুন পোশাক উপস্থাপন করা হয়েছিল, এরপর থেকে এ বিষয়ে আর কোনো আপডেট নেই।”
বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর উপপরিচালক (গণসংযোগ) মো. আশিকুজ্জামান জানান, “আনসার সদস্যদের নতুন ইউনিফর্ম এখনো চূড়ান্ত হয়নি।”
