ছোটখাট নয়, বরং বড় শক্তি নিয়ে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করা হবে বলে মনে করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আবার জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ও জুলাই সনদের গণভোট না হলে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা বলেছে।
এর আগে সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছিলেন, নভেম্বরের পর আর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক হবে না। কিন্তু পরক্ষণেই অন্তর্বর্তী সরকার বিবৃতি দিয়ে জানায়, উপদেষ্টা পরিষদ নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার আগপর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাবে।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য, তথ্য উপদেষ্টার মন্তব্য ও অন্তর্বর্তী সরকারের পরষ্পর বিরোধী বিবৃতি, চলমান তত্ত্বাবধায় সরকার পুনর্বহালের শুনানি ও জুলাই সনদের গণভোটের নতুন দাবির পর জনমনে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে, তাহলে এখনও কি কেউ নির্বাচন প্রলম্বিত করতে চান? সে কারণেই কী অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে? না কি তত্ত্বাবধায় সরকারের আদলেই এই অন্তর্বর্তী সরকারই শুধুমাত্র নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করবে? আর ড. ইউনূসের বক্তব্যের বড় শক্তিই বা কারা যা নির্বাচন চান না?
বুধবার (২৯ অক্টোবর) যমুনায় নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে ড. ইউনূস বলেন, আসন্ন নির্বাচন বানচাল করার জন্য দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে বড় শক্তি কাজ করবে এবং এই নির্বাচন হবে চ্যালেঞ্জিং।
এর আগে রোববার (২৬ অক্টোবর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছিলেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন। নভেম্বরের পর মন্ত্রিসভার (উপদেষ্টা পরিষদের) বৈঠক আর হবে না, তখন সরকার নির্বাচন কমিশনের অধীনে তার ভূমিকা পালন করবে। এরপরেই ২৭ অক্টোবর নভেম্বরের পর মন্ত্রিসভার (উপদেষ্টা পরিষদের) বৈঠক আর হবে না, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের এমন বক্তব্য বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে বলে মনে করে বিবৃতি দেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
বিবৃতিতে বলা হয়, উপদেষ্টা পরিষদ নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার আগপর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাবে। যার অর্থ নভেম্বরের পরও উপদেষ্টা পরিষদের সভা এখনকার মতোই চলবে, সংস্কারকাজও থেমে থাকবে না।
অন্যদিকে জুলাই সনদ ও এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি, গণভোট ও অন্তর্বর্তী সরকার ত্রয়োদশ নির্বাচন আয়োজন করবে, না কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ দায়িত্ব পালন করবে এ নিয়ে বিতর্ক এখন রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন করে বিভক্ত করছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই মুহূর্তে ফিরিয়ে আনার সুযোগ নেই। আমরা বিচার বিভাগকে সেই জায়গায় টেনে আনতে চাই না।
একই সুরে কথা বলেছেন জামায়াত নেতা অ্যাডভোকেট শিশির মনির। তিনি বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক ফিরলেও এবারের নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই হবে।
আর বিএনটি বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা পালন করতে পারে। এ ছাড়া বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জুলাই সনদে দেওয়া নোট অব ডিসেন্ট না রাখাকে প্রতারণা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, আপনি জনগণের নিকট প্রতিশ্রতিবদ্ধ। যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন তা সম্পাদন করে একটি নির্বাচন উপহার দেবেন। এর যদি ব্যত্যয় ঘটে, তার দায় কিন্তু আপনাকেই বহন করতে হবে।
রাজনীতির এই চলমান জটিলতায় সাধারণ জনগণের মধ্যেও আগামী নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে কি না জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামছুজ্জামান দুদু বলেন, আমরা মনে করি, দেশি-বিদেশি নানা মহল নানাভাবে নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের এমন কিছু বলা ঠিক হবে না যেটা সাধারণ জনগণের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তবে আমরা মনে করি ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারই তাদের প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যেই একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. রাশেদ আলম ভূঁইয়া বলেন, এয়ারপোর্টে অগ্নিসংযোগ, সারাদেশে আগুনের কিছু ঘটনার পর মানুষের মধ্যে এমনিতেই আতঙ্ক, এরমধ্যে সরকারের উপদেষ্টাদের এমন কিছু বলা ঠিক না যা মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে ভয় বা অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করে। দেশের স্থিতিশীলতার জন্য দেশে এই মুহূর্তে নির্বাচন দরকার। আর অন্তর্বর্তী সরকারই সেই নির্বাচনের আয়োজন করবে। তারপরও যদি দেশের প্রধান দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে নির্বাচন পেছানোর আবেদন করে সেক্ষেত্রে এই নির্বাচন পেছাতে পারে। কিন্তু নির্বাচন হয়ে যাওয়া দরকার দেশের স্থিতিশীলতার জন্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, উপদেষ্টাদের বক্তব্য ও কর্মকান্ডে এটা স্পষ্ট যে, কেউ কেউ এখনও মনে করে দৈবক্রমে নির্বাচন নাও হতে পারে। এজন্যই অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে যাওয়ার কথা উঠছে। নিয়মানুযায়ী তফসিল ঘোষণার পর মন্ত্রিসভার রুটিন কাজের বাইরে কিছু করার সুযোগ থাকার কথা না। আজকেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের শুনানি হলো। বিএনপিও চাচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনবর্হাল হোক। কারা এটা চাচ্ছে না? যারা চাচ্ছে না তারাই হয়তো একটা ফাঁক ফোকর রাখতে চাচ্ছে যাতে কিছু একটা হলেও যেন নাটাই তাদের হাতেই থাকে।
এ বিষয়ে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নুরুল আমি বেপারি বলেন, নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র তো হচ্ছেই। প্রধান উপদেষ্টাও বললেন।
এর আগে আমরা মনে হয় তথ্য উপদেষ্টা বুঝাতে চেয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকার তফসিল ঘোষণার পর বড় ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। এজন্য মিটিংয়ে বসবেন না তারা। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমেরিকাসহ পরাশক্তিগুলো ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন চায়। তাই যে যাই বলুক ফেব্রুয়ারিতে ইউনূস সরকার নির্বাচন দিয়ে দেবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আব্দুল লতিফ মাসুম বলেন, তথ্য উপদেষ্টার বক্তব্য ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার বিবৃতি দিয়ে পরিষ্কার করেছে। এই সরকারই নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব পালন করবে। আমার মনে হয় না, এরপরও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে কোনো বিভ্রান্তির সুযোগ আছে।