বন্দুকের মুখে ব্যালট: আতঙ্ক আর প্রহসনের নির্বাচনে মিয়ানমার

Share

টানা পাঁচ বছর পর ভোটের মুখ দেখল মিয়ানমার। অথচ ২০২০ সালের নির্বাচনের সেই উচ্ছ্বাস, আমেজ, উৎসবের কিছুই নেই জনমনে। লোকারণ্য দূরের কথা-বলা চলে নির্জন-নিস্তব্ধ আর আতঙ্কের মাঝেই শেষ হলো জান্তা আয়োজিত প্রথম দফার ভোট। গণতন্ত্রের এ বৃহত্তম উৎসবে ভোটকেন্দ্রগুলোও ছিল ফাঁকা ফাঁকা। বেশির ভাগই ভোট দিতে আসেননি। কারা ভোট দিচ্ছেন, কারা আসেননি-সেটি দেখার জন্যও পথে পথে, ভোটকেন্দ্র আশপাশে মোতায়েন ছিল উর্দিবিহীন সেনাসদস্য। যারা ভোট দিয়েছেন তারাও ‘পিঠ বাঁচাতে’, সেনাবাহিনীর শাস্তির ভয়ে। সরকারি চাকরিজীবিরা কেন্দ্রে গেছেন ওপরওয়ালাদের নির্দেশে। এককথায় মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে, ভয় দেখিয়েই ভোটার টানছে জান্তা! ইরাবতী, বিবিসি, রয়টার্স।

রোববার দেশটির জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেন মান্দালয় শহরের ৪২ বছর বয়সি সরকারি কর্মচারী ওয়াই ইয়ান অং। তবে নিজের ইচ্ছেতে নয়, বাধ্য হয়েই। তার দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, কর্মীরা ভোটে অংশগ্রহণ করছেন কি না-তা যাচাই করা হবে। জান্তার শাস্তি থেকে বাঁচতেই এদিন ভোট দিতে যান তিনি।

ইয়ান বলেন, ‘আমার মতো মানুষের জন্য এটা আসলে কোনো পছন্দের বিষয় নয়।’

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার প্রহসনের এ নির্বাচনে ভোটের মাঠে লোক আনতে আগেই কলকাঠি নেড়ে রেখেছে দেশটির সেনাবাহিনী। সরকারি চাপ, নজরদারি, গ্রেফতার আর শাস্তির আশঙ্কায় ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধ্য হচ্ছেন ভোটাররা। এতকিছুর পরও ভোটার উপস্থিতি ছিল একেবারেই ‘হাতে গোনা’। এএফপি, আল-জাজিরা।

নির্বাচনে জয় লাভ করতে দেশজুড়ে এই আতঙ্ক ছয় মাস আগেই ছড়িয়ে দিয়েছে জান্তা সরকার। চলতি বছরের জুলাই মাসে ‘নির্বাচন সুরক্ষা আইন’ করেছে জান্তা সরকার। নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা করাকে অপরাধ ঘোষণা করে নতুন আইন পাশ করে দেশটি। ভোটের আগে নতুন এই আইনে ভোট বিরোধিতা করলে শাস্তি হতে পারে এক বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ইতোমধ্যে ৩২৯ জনকে এই আইনে আটক করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বেশির ভাগই এড়িয়ে যান সাংবাদিকদের।

অনেক অনুরোধের পর ইয়াঙ্গুন শহরের ৪১ বছর বয়সি খুচরা পণ্যের দোকানি নিলার নয়ে এএফপিকে বলেন, ‘না চাইলেও, সবাই জানে যে তাদের ভোট দিতে আসতেই হবে।’ বড় বড় শহরগুলোতে ভোটের আগের রাতেই ঘিরে ফেলা হয় ভোটকেন্দ্রগুলো।

রাতে কড়া নজর রাখা হয় স্টেশনগুলোতেও। প্রতিটি কেন্দ্রের বাইরে নিরাপত্তাকর্মীদের মোতায়েন করা হয়। সড়কের মোড়ে মোড়েও সশস্ত্র পুলিশ। প্রথমবারের মতো ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার করা হয় দেশটিতে। এই মেশিনে নিজের পছন্দমতো নাম লেখার সুযোগ নেই। এমনকি ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যালট বাতিল করারও ব্যবস্থাও নেই। গৃহযুদ্ধের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের প্রথম ধাপ শুরু হয়েছে মিয়ানমারে। প্রথম ধাপের ভোটগ্রহণের পর আগামী ১১ জানুয়ারি ও ২৫ জানুয়ারি আরও দুটি দফায় ভোট অনুষ্ঠিত হবে। তবে ফলাফলের কোনো দিনক্ষণ নেই!

২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নোবেলজয়ী অং সান সু চির নির্বাচিত সরকার উৎখাতের পর প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে দেশটিতে। রোববার ভোর ৬টা থেকে শুরু হয় ভোটগ্রহণ। শেষ হয় বিকাল ৪টায়। ইয়াঙ্গুন ও মান্দালয়ের মতো বড় শহরগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল তুলনামূলকভাবে কম। ভোটারদের বেশির ভাগই মধ্য বয়সি। তরুণদের উপস্থিতি খুবই কম। যারা অংশ নিয়েছেন তারাও আবার গেছেন বাধ্য হয়েই। ভোটের আগে অনেক মানুষ ভোট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও জান্তার ভয়ে সেই সিদ্ধান্ত পালটে ফেলেন তারা।

সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ যাচাইয়ের কথা বলেও হুমকি দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি টম অ্যান্ড্রুজ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই সামরিক-পরিচালিত নির্বাচন প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানিয়েছেন।

চলমান ভোটের মাঝেই তিনি বলেছেন, ‘জান্তা বেসামরিকদের ওপর বোমা ফেলছে, রাজনৈতিক নেতাদের কারাবন্দি করছে এবং সব ধরনের ভিন্নমতকে অপরাধে পরিণত করেছে। তাদের আয়োজিত ভোট কোনো নির্বাচন নয়, এটি বন্দুকের মুখে মঞ্চস্থ এক প্রহসন।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটি সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ নয়, বরং দমন-পীড়ন ও বিভাজনকে দীর্ঘায়িত করবে।’

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান ভলকার তুর্ক বলেন, মিয়ানমারে মতপ্রকাশ, সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার কোনো পরিবেশ নেই। তিনি আরও বলেন, সাধারণ মানুষ সবদিক থেকেই চাপে রয়েছে। একদিকে সেনাবাহিনী, অন্যদিকে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ভোট বর্জনের হুমকি।

নির্বাচনে সমর্থন নেই জনগণের : ইয়াংগুনের কেন্দ্রের একটি ভোটকেন্দ্রে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ভোটাররা। বেশির ভাগই প্রবীণ নাগরিক। বাচ্চাদের কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মায়েরা। বাজারের ঝুড়ি নিয়ে একই সারিতে ছিলেন গৃহিণীরাও। তবে তরুণ ভোটাররা নেই বললেই চলে। সেখানে প্রায় ১,৪০০ নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছে মাত্র ৫০০ জন।

মান্দালয়ের এক যুবকও জানিয়েছেন, ‘যারা ভোট দিয়েছেন, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই বৃদ্ধ। আমি মনে করি, কেউই এই বিশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়াতে চান না। মানুষ হয়তো এই নির্বাচনের ন্যায্যতায় বিশ্বাস করে না।’

রাখাইন রাজ্যের ৩৫ বছর বয়সি কিয়াও মিন থেইন বলেন, ‘আমি মনে করি, এই নির্বাচন ন্যায়সংগত নয়। যা মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হচ্ছে। কোনো পরিবর্তন হবে না। তারা শুধু সেনাদের পোশাক পালটে সাধারণ নাগরিকের পেশাকে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে।’

Read more