জাতীয় সমাবেশের আড়ালে শক্তির জানান দিতে চায় জামায়াতজামায়াতে ইসলামীর লোগো
সাত দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আগামীকাল শনিবার (১৯ জুলাই) বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জাতীয় সমাবেশ। এই সমাবেশের মাধ্যমে মূলত অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে নিজেদের শক্তির জানান দিতে চায় দলটি।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে তীব্র মতবিরোধ ও বিতর্ক চলছে সে সময়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জামায়াত এই সমাবেশ।
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এককভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় সমাবেশের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এর আগে বিএনপির সঙ্গে যৌথভাবে কয়েকটি সমাবেশে অংশ নিলেও এককভাবে এটিই প্রথম। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে সভাপতিত্ব করবেন জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান।
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপি, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগঠন রাজধানীতে বড় সমাবেশ করে। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলন, ওলামা-মাশায়েখ বাংলাদেশ ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ভিন্নভিন্ন ইস্যুতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করেছে। বিএনপি নয়াপল্টনে কয়েক দফা সমাবেশ করেছে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী কারাবন্দি নেতা (বর্তমানে মুক্ত) এ টি এম আজহারুল ইসলামের মুক্তির দাবিতে পুরানা পল্টন মোড়ে একটি সমাবেশ ছাড়া রাজধানীতে বড় কোনো জমায়েত করেনি।
৭-দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে জাতীয় সমাবেশের ডাক দিলেও অন্তরালে নানান হিসাবনিকাশ রয়েছে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দাবিগুলো হলো- অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতকরণ, সকল গণহত্যার বিচার, প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার, জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন, পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং এক কোটিরও বেশি প্রবাসীদের ভোট দানের ব্যবস্থার করা।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের বলেন, স্বাধীনতার পর বিগত ৫৪ বছরে আমরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছি, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অধিকার হারিয়েছি। ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বাকস্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সাংবিধানিক অধিকার আমরা যতটুকু ভোগ করতে পারছি এবং এখন জাতীয় সমাবেশ আয়োজনের সুযোগ পেয়েছি।
জানা গেছে, আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে সর্বোচ্চ শক্তি প্রদর্শন করবে জামায়াত। সেই লক্ষ্যে ইসলামী দলগুলোকে পাশে চায় দলটি। একইসঙ্গে ইসলামপন্থি ভোটগুলোকে এক করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তারা। আসন্ন সমাবেশ থেকে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দলের অবস্থান, দৃশ্যমান বিচার ও প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত ইসলামী দলগুলোকে এক কাতারে আনাসহ গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেওয়া হতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
বিগত সময়ে জামায়াত কোণঠাসা থাকলেও গণ-অভ্যুত্থানের পর স্বতঃস্ফূর্ত কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লাসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনও ফিরে পেয়েছে দলটি। এখন আগামী নির্বাচনে জামায়াতের শক্তি প্রদর্শনের পালা।
৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর এ সমাবেশ হবে জামায়াতের সবচেয়ে বড় সমাবেশ। এ কর্মসূচি ঘিরে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক মহলে চলছে ব্যাপক আলোচনা। কেউ কেউ এটিকে নির্বাচনপূর্ব একটি কৌশলগত অবস্থান হিসেবেও দেখছেন। যেখানে একটি বৃহৎ জনসমর্থনের ভিত্তিতে প্রভাব তৈরির চেষ্টা করছে দলটি।
যদিও জামায়াত বলছে, ৭ দফা দাবিতে শুধু তাদের দলের নয়, বরং এ সমাবেশ হবে দেশের সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও ন্যায্যতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি। জাতীয় সমাবেশ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ। ব্যাপক জনসমাগম ও শোডাউনের মধ্য দিয়েই দেশবাসীকে নির্বাচনী বার্তা দেওয়া হবে।
দলটির পক্ষ থেকে জানা যায়, আগামী ১৯ জুলাই ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় সমাবেশ হবে তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জমায়েত। এ লক্ষ্যে প্রতিদিনই রাজধানীসহ দেশজুড়ে চলছে মিছিল, মিটিং ও গণসংযোগ। সমাবেশ সফল করতে ট্রেন ও লঞ্চ বাদ দিয়ে ভাড়া করা হয়েছে ১০ হাজারের মতো বাস। সমাবেশে ১০ লাখের বেশি নেতাকর্মীর উপস্থিতি আশা করা হচ্ছে। শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষায় ৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবক দায়িত্ব পালন করবেন।
দলটি আরও জানায়, সমাবেশকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় রাখতে ছয় হাজার স্বেচ্ছাসেবক, সমাবেশস্থলে ১৫টি মেডিকেল বুথ ও বিভিন্ন জেলা থেকে আসা গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ১৫টি স্পট, সমাবেশ বাস্তবায়নে জামায়াত ৮টি উপ-কমিটি গঠন করেছে। উপ-কমিটিগুলোর তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত হবে এই সমাবেশ।
শনিবার বেলা দুইটায় মূল সমাবেশ শুরু হবে। তবে জামায়াতের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পক্ষ থেকে সকাল ১০টা থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হবে। মূল সমাবেশে উপস্থিত থাকবেন বিভিন্ন ইসলামী দল ও রাজনৈতিক দলের নেতারা, জুলাই শহীদ পরিবারের সদস্যরা ও জুলাই আহতরা।
সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে সম্ভাব্য দুর্ভোগের জন্য নগরবাসীর কাছে আগাম ক্ষমা প্রার্থনা করেছে দলটি। দুর্ভোগের বিষয়টিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে নগরবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন দলের নেতারা।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আমরা ঐতিহাসিক জমায়েত করতে চাই সোহরাওয়ার্দীতে। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দরকার, তা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত ফ্যাসিবাদীদের হাতে যারা জীবন দিয়েছেন, নিহত হয়েছেন তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এই গণহত্যার বিচার অবিলম্বে সম্পন্ন করতে হবে। নির্বাচনের পূর্বে যেন এই বিচার জাতির সামনে দৃশ্যমান হয়, এটা আমাদের জাতীয় সমাবেশের অন্যতম দাবি। কোনো ষড়যন্ত্র যেন এই সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে। আবারো নির্বাচনের নামে প্রহসন হবে, তা জনগণ কিছুতেই মেনে নেবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থেই এই সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের জানান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এককভাবে জামায়াতে ইসলামী কখনো জনসভা করেনি। এটি হবে আমাদের প্রথম সমাবেশ।
সুষ্ঠু নির্বাচন, তার আগে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করা, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) নির্বাচন অনুষ্ঠান ও তার আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে জনমত গঠনের লক্ষ্যে এ সমাবেশ হবে বলেও উল্লেখ করেন এই নেতা।