কখনো কখনো গল্পের শেষে মধুরেণ সমাপয়েৎ এর চেয়ে বুঝি ট্র্যাজেডিই বেশি মনে লেগে থাকে! নাহলে বলুন সোহরাব-রোস্তমের গল্পটা কেন আপনার মনে আছে? ‘রোমিও-জুলিয়েট’ বা ‘নরওয়েজিয়ান উড’–এর মতো উপন্যাস কেন জনপ্রিয়তা পায়? কেনই বা ‘কোথাও কেউ নেই’ কালজয়ী সৃষ্টি হয়ে রয়?
ক্রিকেট মাঠের এমন এক ট্র্যাজিক গল্প একটা সংখ্যাকে ঘিরে, সংখ্যাটা হচ্ছে– ১৯৪। আজ থেকে ২৮ বছর আগে ক্রিকেটে এই সংখ্যাটাকে রীতিমতো প্যাটেন্ট করে নিজের করে নিয়েছিলেন সাঈদ আনোয়ার।
২১ মে, ১৯৯৭। ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপের বাঁচা মরার লড়াই, জিতলেই ফাইনালে, এমন সমীকরণ নিয়ে মুখোমুখি ভারত আর পাকিস্তান, তা দেখতে চিপকে হাজির হাজার ত্রিশেক দর্শক। সাঈদ আনোয়ার বেছে নিলেন সে মঞ্চটাকেই।
এর আগ পর্যন্ত রেকর্ডটা ছিল ভিভ রিচার্ডসের দখলে। কিং ভিভের ম্যানচেস্টার কীর্তির এক যুগেরও বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছিল। মাঝে একবার ‘পুঁচকে’ আরব আমিরাতের বিপক্ষে গ্যারি কারস্টেন ১৮৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন বটে, কিন্তু ডাবল সেঞ্চুরি আর ছোঁয়া হয়নি। তবে সে দুই ইনিংস ডাবল না পাওয়ার আফসোস জাগায়নি কারো মনেই। সেটা জাগিয়ে দিয়েছিল সাঈদ আনোয়ারের ওই ইনিংস।
সাঈদ আনোয়ার তখন ছিলেন সময়ের সেরা ব্যাটার। শচীন টেন্ডুলকারের সঙ্গে এক ব্র্যাকেটে তার নামটাও উচ্চারিত হয়। দুজনের দ্বৈরথটাও ছিল দেখার মতো, আজ এই রেকর্ডটা শচীন করছেন তো কাল সাঈদ।
সেই সাঈদ যেন ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপে রান করতেই ভুলে গিয়েছিলেন। একের পর এক ইনিংস খেলে যাচ্ছেন, ফিফটিও ছিল না নামের পাশে। রানে ফিরতে তিনি বেছে নিয়েছিলেন ভারতের বিপক্ষে এই ম্যাচটাকেই।
ওপাশে শহীদ আফ্রিদি আউট হয়ে গেলেন দ্রুতই। তবে ওপাশে সাঈদ আনোয়ার একাই ‘শো’ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ওপাশে যে ভারতীয় বোলারই আসছিলেন, তুলোধুনো করছিলেন তাকেই। ভেঙ্কটেশ প্রসাদকে মিডউইকেট দিয়ে ছয় মেরে জানান দেন আজ বড় কিছুর দিন।
প্রস্তুতিটা নাকি আরও আগে থেকেই নিচ্ছিলেন তিনি। তার রুমমেট সাকলাইন মুশতাক এক সাক্ষাৎকারে জানান, বেশ কিছু দিন ধরে বাড়তি সময় নেটে দিচ্ছিলেন, ব্যাটিংয়ের ছোট ছোট বিষয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন!
তার ফলটা দেখা যায় ২৮ বছর আগের এই দিনে। ১৫ ওভারের আগেই তুলে নেন হাফসেঞ্চুরি। চিপকে সেদিন গরমও পড়েছিল বেশ। তীব্র গরমে এমন খাটুনিতে ক্র্যাম্প করাটা খুব স্বাভাবিক, সাঈদ আনোয়ারের সেটা হলোও। ১৯তম ওভারে আফ্রিদিকে আনেন রানার হিসেবে, ৪৭তম ওভারে যখন তিনি আউট হয়েছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আফ্রিদি ছিলেন তার সঙ্গেই।
তাতে অবশ্য সাঈদেরই ‘লাভ’ হয়েছে, মনোযোগটা শুধুই বাউন্ডারিতে দেওয়া গেছে। ২২ চার আর ৫ ছক্কা জানান দিচ্ছে, কাজটা নেহায়েত মন্দ করেননি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঝাপটা গেছে ৪১তম ওভারে, অনিল কুম্বলের ওপর দিয়ে। ৩ ছয় আর ১ চার মারেন সেই ওভারে, ১৫০ও ছুঁয়ে ফেলেন সে ওভারেই।
৪১তম ওভারেই ১৫০, দুইশো ছোঁয়া তো খুব সম্ভব! ৪৭তম ওভার করতে আসা শচীনকে যখন টানা দুটো চার মেরে বসলেন, তখন মনে হচ্ছিল এই তো আর একটু! ওয়ানডের প্রথম ডাবল এলো বলে! চিপকের হাজার ত্রিশেক দর্শক তখন ইতিহাসের অপেক্ষায়।
অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্সটা হলো ঠিক তখন। শচীনকে সুইপ করতে গেলেন সাঈদ। টপ এজড হয়ে বলটা ওপরে উঠে গেল। শর্ট ফাইন লেগ থেকে দৌড়ে গিয়ে ক্যাচ নেন সৌরভ গাঙ্গুলি। ১৪৭ বলে ১৯৪ রানে থামে সাঈদ আনোয়ারের ইনিংস।
ডাবল সেঞ্চুরিটা হয়নি। তবে তার আগে যা করেছেন, তাতে চেন্নাইয়ের দর্শকের মন জিতে নিয়েছিলেন বটে। সে কারণে তিনি যখন সাজঘরে ফিরছেন, তখন পুরো গ্যালারি দাঁড়িয়ে সম্মান জানাল তাকে।
ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরির বিষয়টা এখন নিয়মিত না হলেও চোখ সওয়া হয়ে গেছে বেশ। এখন পর্যন্ত ১২ বার ডাবল সেঞ্চুরি ছুঁয়েছেন ব্যাটাররা। তবে এরপরও সাঈদ আনোয়ারের ১৯৪ কালজয়ী হয়ে আছে, কারণটা সে যুগটার কারণে। নো বলে ফ্রি হিট, পাওয়ারপ্লের মতো ব্যাটিং বান্ধব নিয়মের বালাই ছিল না যখন, সে যুগে দাঁড়িয়ে ‘ওয়ানডেতে ডাবল হতে পারে না’ মিথ ভেঙে দেওয়ার কাজটা যে তার এই ইনিংসই করেছিল!
ইনিংসটা কালজয়ী হয়তো আরও একটা কারণে, সেদিন চিপকে যখন তিনি বিদায় নিচ্ছেন, তখন তার ইনিংস ঘিরে আফসোস, ইশ আর ছয়টা রানই তো ছিল মাত্র! এই আফসোস ক্রিকেটপ্রেমীদের গলায় শোনা গেছে অন্তত আরও এক যুগ! সেদিন যদি ডাবলের ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ হয়েই যেত, ইনিংসটার আবেদন কি এমন থাকত?