যশোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পিকুলের বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ

Share

যশোর প্রতিনিধি যশোর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল তার দায়িত্ব পালন কালে জেলা পরিষদের আওতায় ৮ উপজেলার বিভিন্ন স্থানের জমি ও দোকান কোনো নিয়ম ছাড়াই বরাদ্দ দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। বেহাত হওয়া এসব সম্পত্তি বরাদ্দের কোনো প্রমাণ নেই জেলা পরিষদের। কোনো ইজারা মূল্যও জমা হয়নি জেলা পরিষদে। এমনকি যারা ইজারা নিয়েছেন তাদের কাছেও কোনো প্রমাণ নেই। এরপরেও জেলা পরিষদের মালিকানাধীন বহু স্থানে গড়ে উঠেছে ভবন। জমি উদ্ধারতো দূরের কথা শনাক্ত করতে গিয়েই হিমিশিম খাচ্ছে জেলা পরিষদ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে গ্রহণ করা, সভা করে ইজারা নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত দেওয়া, দলীয় বিবেচনায় জমি বা দোকান বরাদ্দ দেওয়াসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। গত ১০ বছর চলেছে সীমাহীন লুট। খোদ চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল ও তার ছেলে ছাত্রলীগ নেতা তানজীব নওশাদ পল্লবের জড়িত থাকার বিষয়টি স্পষ্ট। তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন ইজাজ, দোকানি মালেক, জেলা পরিষদের এও লুৎফর রহমানসহ বেশ কয়েকজন।

জেলা পরিষদের জমির পরিমাণ ২ হাজার ৪৪৯ একর। নিয়ম বহির্ভূ বরাদ্দের কারণে জেলাপরিষদের ৮০ ভাগই বেদখল হয়ে আছে বলে জেলা সমন্বয়সভায় অভিযোগ তুলেছেন খোদ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান। অবৈধ দখলদাররা নিজেদের মতো ভোগ করছেন এর জন্যে জেলা পরিষদ কোনো কর, ট্যাক্স, ভাড়া পাচ্ছে না। যারা এক বছরের চুক্তিতে এ সময় লিজ নিয়েছিলেন তারা যুগের পর যুগ ভোগদখলে রেখে নিজেদের সম্পত্তির মতো ব্যবহার করছেন। এমন কি কোথাও কোথাও জেলা পরিষদের জমি বিক্রির মতো ঘটনা ঘটেছে।

কীভাবে এত বিপুল অর্থ গ্রহণ ও অনিয়ম হয়েছে তার নমুনা দিতে জেলা পরিষদ সূত্র জানায়, গত ১০ বছর সবচেয়ে বেশি অনিয়ম চলেছে জেলাপরিষদের সম্পদ ও তার ইজারা ও বন্টন নিয়ে। জেলা পরিষদের পাশে দক্ষিণের সুপার মার্কেটের ৭৬টি দোকানের জমি ইজারার মাধ্যমে বরাদ্দের নামে ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হয়েছে। এর সিংহভাগই সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুজামামান পিকুলের কাছে গেছে বলে জমি ইজারায় পার্টি ধরে দেওয়ার সহকারী দোকানি মালেক, দোকানি তাজুল ইসলাম দীপু, ইজারা বঞ্চিত আবু তাহের, সালাউদ্দিন মিঠুসহ কয়েকজন দাবি করেন।

অফিসিয়ালি চেয়ারম্যানের হয়ে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত এও লুৎফর রহমান এসব কাজ সম্পন্ন করে চেয়ারম্যানের কাছে ইজারা গ্রহীতাদের নিয়ে নিয়ে যেতেন বলেও অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। ৩ সাড়ে ৩ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়েও ৫৬ বর্গফুট জায়গা ইজারা পায়নি অনেকেই। তেমন একজন হলেন কাজীপাড়ার আবু তাহের। যখন ইনস্টিটিউটের মধ্যে এই মার্কেট ছিল তখনো তার দোকান ছিল অথচ নতুন করে জেলাপরিষদ বরাদ্দ দেওয়ার সময় স্পষ্টভাবেই চেয়ারম্যান পিকুল প্রথমে মালেক তারপর লুৎফরের মাধ্যমে জানান যে তিনি বিএনপি করেন তাই তাকে ঘরের জমি দেওয়া হবে না।

এসময় তিনি স্ত্রী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তার মেয়েসহ পিকুলের চেম্বারে দেখা করলে তখনও চেয়ারম্যান পিকুল একই কথা জানান। এর আগেই তিনি লুৎফর ও মালেকের মাধ্যমে ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা দেন যা এখনো ফেরত পাননি। এ সময় জেলাপরিষদ চেয়ারম্যান তাকে আরও জানিয়েছিলেন, তার ছেলে ও জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানজীব নওশাদ পল্লবের সাথে ৪০ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ওই দোকানগুলো ইজারা দেবে, টাকা আদায় করবে।

ঘরের জন্যে জায়গা বরাদ্দ না পাওয়া আর একজন হলেন বিএনপি কর্মী ও সেখানকার দীর্ঘ দিনের দোকানি সালাহ উদ্দিন মিঠু। তিনিও একই ধরনের অভিযোগ তোলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ইজারা গ্রহীতা দোকানি টাকা লেনদেন করেন। মাঝে ছিলেন মালেক ও লুৎফর। এছাড়াও কাউন্সিলর হাজী সুমনের ঘনিষ্ঠজন (অলিখিত সভাপতি) শহিদুলসহ কয়েকজনের সিন্ডিকেট গড়ে ইজারার নামে ব্যবসার বিভিন্ন দিক উল্লেখ করেন।

আবার একজন ইজারা নিয়ে এই সিন্ডিকেটের সহায়তায় ৫ থেকে ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে হাত বদল ঘটিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি মালেক বা লুৎফর নিজেদের কারো নামে বররাদ্দ নিয়ে হাত বদল করে সেখান থেকে মোটা অর্থ কামিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এর নতুন ক্রেতারা হলেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের কর্মচারী সবুজ, পৌরসভার কর্মচারী রতন, ভূমি অফিসের কর্মচারী ইস্্রাফিল।

অভিযোগ রয়েছে এসব কাজের স্বার্থে শহিদুলের গাড়িখানা শাখার ন্যাশনাল ব্যাংকে এক সময় এককালীন ৬০-৬৫ লাখ টাকা জমা করা হয় এবং মালেকের আর এন রোড শাখার সোনালী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টেও বিপুল অর্থ জমা হয় যা পরবর্তীতে চেয়ারম্যান পিকুলের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অভিযোগকারীদের দাবি যথাযথ কর্তৃপক্ষ ব্যাংক একাউন্ট তদন্ত করলে এর সত্যতা পাবে। এ সব অপরাধ ও দুর্নীতি নিয়ে সালাইুদ্দন মিঠু সে সময় দুর্নীতি দমন কমিশন যশোরেও অভিযোগ দিয়েছিল বলে দাবি করেন। এদিকে বিক্রেতাদের মধ্যে নাম এসেছে পলাশ, যুবলীগের তাহের বিশ্বাস, মালেকের ভাইপো স্বপনসহ বেশ কয়েকজন।

অভিযোগ বিষয়ে পান দোকানদার মালেক জানান, তিনি দোকান নিয়েছেন, তিনি কারো সহায়তা করেননি তবে চেয়ারম্যানকে টাকা দিয়েই বরাদ্দ পেতে হতো। চেয়ারম্যান এবং তার ছেলে ও দলীয় লোকজনই লেনদেন করতো। তিনি দাবি করেন, লুৎফর চেয়ারম্যানের কর্মচারী, চেয়ারম্যান যেভাবে চান তাকে তো তাই করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি বা লুৎফর নিজেরা কোনো অর্থিক সুবিধা নেননি। একইভাবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন জেলাপরিষদ কর্মচারী লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, যা করার চেয়ারম্যান ও তার ছেলে করেছে, আমি কর্মচারী হুকুমের দাস মাত্র।

জেলাপরিষদের একাধিক সূত্র জানায়, এভাবে যে যখন যে দায়িত্ব পেয়েছে সে তার মতো সাজিয়ে ঊর্ধ্বতনকে খুশি করেছে। ফলে প্রকৃত সম্পদের হিসেব কোথাও ঠিকমতো পাওয়া যাবে না। জেলা পরিষদের সিএ আসাদুজ্জামানের কাছে জানতে চাইলে সেখান থেকে বলা হয় ‘আমি ১১টা দোকানের হিসেব দিতে পারবো’।

ভারপ্রাপ্ত এও আলমগীরের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান,‘আগের এও লুৎফর সাহেব ৭৬টা দোকানের হিসেব তুলতেন কোথায় তার কাগজপত্র তা তিনি জানেন না’। অন্য সেকশনগুলিতে গেলেও একই রকম কথা শোনা যায়।

সূত্র জানায়, জেলা পরিষদ সরাসরি দোকান বা মার্কেট বরাদ্দ দিতে পারে না। ছাদওয়ালা মার্কেট করতে গেলে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি দরকার হয়। কিন্তু পরিষদ সহজে জমি ইজারা দিতে পারে। জমি হয় এক বছরের জন্য। পরবর্তীতে বছর তা নবায়ন করতে হয়। সূত্র জানায়, এমন নিয়ম থাকলেও অজানা কারণে ২০১৮ সালে তৎকালীর জেলাপরিষদ চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুলের নেতৃত্বে সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, আর কারো জমি বা ইজারা নবায়ন করা লাগবে না। সেই থেকে বেশিরভাগ বরাদ্দ ও ইজারা থেকে আয় ও প্রাপ্তি বন্ধ হয়ে গেছে, জমিও জেলাপরিষদের নিয়ন্ত্রণে নেই।

সূত্র আরও জানায়, চেয়ারম্যান কাউকে ফ্রি দিতেন না লেনদেন থাকতো। খোদ গাড়িখানা সড়কের পাশের (হোটেল জাবিরের সামনে) প্রায় ৮০ শতক ভোগ করে যাচ্ছে গণপূর্ত বিভাগ। এ নিয়ে মামলাও চলমান রয়েছে।

জেলাপরিষদের কাছ থকে পাওয়া হিসেব অনুযায়ী ইজারা দেওয়া দোকান ও দোকানের জমির মধ্যে সদরে ১১টি দোকান, সুপার মার্কেটে ৭৬টি, উপজেলা সদরে ১০টি, ঝিকরগাছার কৃষ্ণনগরে ৫০টি, বসুন্দিয়ায় ২১টি, বাঘারপাড়ায় ২০টি দোকান, চৌগাছায় ১৩টি দোকান, ছৌগাছার হলুদ হাটের পাশে ৫টি, শার্শার বাগআচঁড়ায় ৮টি দোকানের জমি, সেখানে দোতলা বাড়িও নির্মাণ করেছে গ্রহীতা, মণিরামপুর নেহালপুরে ১৬টি, রাজগঞ্জে ২৮টি, কেশবপুরের আলতাপোলে ৩০টি, সাতবাড়িয়ায় ৬০টি, সৈন্যগাছায় ২০টি, চুকগরে ৭ শতক জায়গা ডা.আবিদ হোসেন সুপার মার্কেট ও বাড়ি করে নিয়েছেন, অভয়নগরের গুয়াখোলায়ও দোকানের ইজারা ছিল।

সূত্র মতে, বাস্তবতা হচ্ছে এই যে হিসেব দেয়া হয়েছে তার বাইরেও বেশ কিছু স্থাপনা, দোকান বা ইজারা রয়েছে তার একটি হলো অভয়নগরে ১১ শতক ও ২২ হাজার ৭৭৬বর্গফুট কৃষি ও বাণিজ্যিক দুটি জমি মজিবর রহমান খানকে ইজারা দেয়া আছে। এখান থেকে বৈধভাবে জেলাপরিষদ ২০১২ থেকে ২০২৪ সালে ভাড়া পেয়েছে সাড়ে ৪ লাখ টাকা, আবার জেলা পরিষদের প্রাচীরের মধ্যে নতুন স্থাপিত দুই কক্ষের দোকান যেমন রয়েছে তেমনি জেলাপরিষদের ২য় গেটে বসানো হয়েছে ২টি দোকান অস্থায়ীভাবে বসিয়ে ভাড়া তুলে নিচ্ছে কর্মচারি সমিতি।

যশোর জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আছাদুুজ্জামান জানান, এটি সম্পপূর্ণরূপে যশোরের জনসাধারণের সম্পদ। বিভিন্ন্ন সময় যদি এই সম্পদ যথেচ্ছ অপব্যহার, অবৈধদখল, ইজারার নামে ব্যক্তিমালিকানায় নিয়ে নেওয়া, বরাদ্দের নামে অর্থবাণিজ্য বা অন্য সুবিধাদি দায়িত্বপ্রাপ্তরা না করতেন তা হলে মানুষের সেবায় শত কোটি টাকা ব্যয় করার ক্ষমতা রাখতো এই প্রতিষ্ঠানটি। বাস্তবতা হচ্ছে ভিন্ন, যখন যে যেভাবে পেরেছে এটাকে স্রেফ ব্যক্তি কাজে লাগিয়েছে। এমনকি দু বছর আগেও প্রতিষ্ঠানটির নামে ৪ কোটি টাকা এফডিআর ছিল না। বর্তমানে অর্ধশত কোটি টাকা এফডিআর হয়েছে । প্রাপ্ত লভ্যাংশ যশোরেরর মানুষের সেবা ও কল্যাণে ব্যয় করা সম্ভব। শত কোটি টাকা এফডিআর করতে পারলে সুফল পেতো এখানকার মানুষ।

গত কয়েক বছর যা হয়েছে তা বলে বোঝানো যাবে না কারণ এর কোনো হিসেবও পাওয়া যাাচ্ছে না। এমনকি কর্মচারীরাও ঊর্ধ্বতনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেরাও যথেচ্ছার করেছেন। সুবিধা নেওয়া চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারী এজাজের বিরুদ্ধে কোটি টাকা নিয়ে আমেরিকায় চলে যাওয়ার ঘটনাও মানুষের মুখে মুখে রয়েছে। এখানকার কোনো কোনো কর্মচারীর নামেও লাখ লাখ টাকা ও সম্পদ অর্জনের খবরও রয়েছে। বিগত ৫ আগস্টের পর অবস্থার পরিবর্তনের জন্যে বেশ কাজ করছি, অতীতে কাজ করতে গিয়ে বিরাগভাজনও হয়েছি।

জেলা পরিষদের সম্পদ ফিরিয়ে আনতেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলা সমন্বয় সভায় স্পষ্ট করেই এখানকার অনিয়ম তুলে ধরা হয়েছে। আগামীতে আরো স্পষ্ট করা হবে।

Read more