কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি: সাত হাজার মানুষের গ্রাম মৌটুপি দুই বড় গোষ্ঠী- কর্তা বংশ ও সরকার বংশ। তাদের বংশপরম্পরায় খুনোখুনির কারণে গ্রামটি পরিচিত দাঙ্গাবাজ গ্রাম হিসেবে। কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার সাদেকপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম মৌটুপি। দুই বড় বংশের আধিপত্য বিস্তার ও পূর্বশত্রুতার জেরে ইতিমধ্যে খুন হয়েছে ১৭ জন মানুষ। আহত হয়েছে হাজারের বেশি। শত শত বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট, আগুন মামুলি ব্যাপার।
কর্তা বংশ আর সরকার বংশের নেতারাই বারবার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বর্তমান চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগ সদস্য সরকার মো. সাফায়েত উল্লাহ সরকার বংশের লোক। এর আগে তার বাবা আবু বক্কর সিদ্দিক তিনবার ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন।
সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি তোফাজ্জল হক কর্তা বংশের লোক। দুই বংশের দুই চেয়ারম্যান এখন তাদের নিজ নিজ বংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
৫৪ বছর আগে কর্তা বংশের কফিল উদ্দিন নামের এক ব্যক্তিকে খুন করেন সরকার বংশের লোক। সেই থেকে বিরোধের শুরু। এখন তাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাফায়েত উল্লাহ ও তোফাজ্জল হক।
সর্বশেষ ৩১ অক্টোবর দুপুরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে সরকার বাড়ির কাইয়ূম মিয়া (৪৫) নামের এক ব্যক্তি খুন হন। এদিন আহত হয় অন্তত ৫০ জন। এর কয়েক দিন আগে একই বংশের ইকবাল মিয়া (২৯) নামের একজন খুন হন।
এর আগে গত ঈদুল আজহার পরদিন কর্তা বংশের নাদিম মিয়া (৫৫) খুন হন। ২০০৫ সালে সরকার বাড়ির সরকার সাফায়েত উল্লাহ চেয়ারম্যানের আপন দুই ভাই ওবাইদুল্লাহ ও হেদায়েত উল্লাহ, তার এক চাচা সায়দুল্লাহ মিয়া খুন হন কর্তা বংশের লোকজনের হাতে।
এভাবে দুই বংশের মধ্যে ঝগড়া-সংঘর্ষে খুনোখুনি চলে আসছে। এসব খুন ও সংঘর্ষের ঘটনায় আদালতে অর্ধশত মামলা চলমান। দুই বংশের কয়েক শ মানুষ আসামি এসব মামলায়।
দুই বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যান কেউ এলাকায় থাকেন না। গ্রামে তাদের বাড়িঘর থাকলেও তারা ভৈরব শহরে বসবাস করেন। সেখান থেকেই এলাকায় ঝগড়া-বিবাদের কলকাঠি নাড়েন। দুজনই একাধিক খুনের মামলার আসামি। কখনো কখনো আদালত থেকে জামিন নেন। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারে না। পুলিশের ভাষায় তারা পলাতক।
জানা যায়, পুলিশ মামলার আসামি ধরতে সাধারণত মৌটুপী গ্রামে যায় না। কখনো গেলে বিরাট দল নিয়ে যেতে হয়। নতুবা হামলার শিকার হতে হয় পুলিশকে। ঝগড়া-সংঘর্ষ লাগলে তা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ এই গ্রামে যেতে সাহস করে না বলে প্রচলিত আছে।
স্থানীয়ভাবে রাজনৈতিক নেতারা বহু চেষ্টা করেও দুই বংশের বিরোধ মীমাংসা করতে পারেননি। বিশেষ করে দুই চেয়ারম্যান মীমাংসায় সম্মতি দেন না। তারা মামলাবাজ হিসেবে চিহ্নিত। মামলায় আসামি করা কিংবা চার্জশিট থেকে নাম বাদ দেওয়ার বাণিজ্য করার অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে।
এই দুই বংশের রেষারেষিতে শান্তিতে নেই অন্য বংশের লোকেরা। মৌটুপী গ্রামের বাসিন্দা মাহবুব হোসেন যেমন বলেন, ‘তাদের হানাহানি থেকে আমরা অন্য বংশের লোকজন দূরে থাকতে চাইলেও তা পারি না। কাউকে না কাউকে সমর্থন দিতে হয়। গত ৫৪ বছরে এই গ্রামে কমপক্ষে দেড় ডজন খুন হয়েছে, আহত হয়েছে হাজারও মানুষ। মামলা হয়েছে শত শত। এসব বিরোধের মূল হোতা দুই চেয়ারম্যান সাফায়েত উল্লাহ ও তোফাজ্জল হক।
একই গ্রামের বাসিন্দা বাচ্চু মিয়া বলেন, মৌটুপী গ্রামে দুজন নেতার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই যুগের পর যুগ ঝগড়া চলছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিলে মৌটুপি গ্রাম নীরব হয়ে যাবে। কয়েক মাস আগে কর্তাবাড়ির নাদিম খুন হলে সরকারবাড়ির অন্তত ২০০ বাড়িঘড়ে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পালিয়ে যায় সরকারবাড়ির শত শত পরিবার। পরে সরকার বংশের ইকবাল খুন হলে কর্তা বংশের শতাধিক বাড়ি লুটপাট হয়। ৩১ অক্টোবর তারা বাড়ি এলে আবার সংঘর্ষে কাইয়ূম খুন হন।’ দুই চেয়ারম্যানকে পরবাসে পাঠালে গ্রামের বিরোধ থামবে, নতুবা নয়- মানুষ এমনটাই বলছে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে সরকার বংশের বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা সরকার মো. সাফায়েত উল্লাহ বলেন, ‘কর্তাবাড়ির বিএনপি নেতা তোফাজ্জল হক এই বিরোধ লাগিয়ে রেখেছে। তারা আমার দুই ভাই ও চাচাকে হত্যা করেছে। গত শুক্রবারের সংঘর্ষের নায়ক তোফাজ্জল। গ্রামের যেকোনো মীমাংসায় আমি রাজি, কিন্তু তোফাজ্জল হক মীমাংসায় রাজি নয়। গ্রামের দাঙ্গার জন্য সে-ই দায়ী।
পাল্টা অভিযোগ করে কর্তা বংশের বিএনপি নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হক বলেন, ‘৫৪ বছর আগে সাফায়েতের বাবা আমার বংশের কফিল উদ্দিনকে গলা কেটে হত্যা করে। কদিন আগে খুন করল আমার ভাই নাদিমকে। আরও খুন করেছে কয়েকজনকে। আমি গ্রামে থাকি না, থাকি ভৈরব শহরে। অথচ একাধিক ঘটনায় সাফায়েত মামলায় আমাকে আসামি করে। তাহলে কীভাবে মীমাংসা করব!
এ বিষয়ে ভৈরব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হাসমত উল্লাহ জানান, ৫৪ বছর ধরে গ্রামের দুই চেয়ারম্যানের বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার চলছে। স্থানীয় জনগণ গ্রামকে দাঙ্গাবাজ গ্রাম বলে ডাকে। আমি দুই মাস হলো থানায় যোগদান করেছি। এরই মধ্যে একটি খুন হলো মৌটুপী গ্রামে। এ নিয়ে দুই বংশের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। তবে আইনশঙ্খলা দমন ও নিয়ন্ত্রণে আমি চেষ্টা করছি।