ব্যাংকের অ্যাপ নামিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার দুই এসআই

ঢাকা অফিস: এক ব্যক্তিকে অপহরণ করে, ব্যাংকের অ্যাপ নামিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার শাহআলী থানার দুই এসআই এলাকায় চলাফেরা করতেন ‘বেপরোয়াভাবে’; সহকর্মীরাও তাদের সম্পর্কে ভালো কিছু বলেননি।

শেরেবাংলা নগর থানার একটি মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন এসআই মো. তুহিন কাজী ও মো. মশিউর রহমান তাপস। এখন তারা আছেন কারাগারে।

তাদের মধ্যে তুহিনের গ্রামের বাড়ির এলাকার একজন জনপ্রতিনিধি বলেছেন, পারিবারিকভাবে আগে তেমন স্বচ্ছল না হলেও সম্প্রতি জমি কেনার পাশাপাশি বাড়ি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এই পুলিশ সদস্য।

এসআই তুহিন ও তাপসের বিষয়ে প্রশ্ন করলে শাহআলী থানার ওসি মওদুত হাওলাদার সাংবাদিকদের  বলেন, “এই থানার ৩১ জন এসআই, ৩৫ জন এএসআই, পুরুষ ও নারী কনস্টেবল এবং সাতজন আনসার সদস্যসহ দেড়শ জনের মত জনবল রয়েছে। আমি থানায় যোগদান করার পরপরই ওই দুই এসআই গ্রেপ্তার হয়েছেন।

তিনি বলেন, ৮ ডিসেম্বর এই থানায় যোগদান করার পর ৯ ডিসেম্বর রাতে থানার সব পুলিশ সদস্যকে ডেকেছিলাম দিক নির্দেশনা দেওয়ার জন্য, কিন্তু ওই দুজন সেই রাতে আসেননি।

যে ঘটনার জন্য তুহিন ও তাপস গ্রেপ্তার হয়েছেন, সেই ঘটনাও ঘটেছিল ৯ ডিসেম্বর।

তুহিন কাজীর গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট জেলার চিতলমারী উপজেলার বড়বাড়িয়া ইউনিয়নে। তিনি ২০২০ সালের ৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ পুলিশে এসআই হিসেবে নিয়োগ পান; শাহআলী থানায় যোগ দেন ২০২১ সালের ১২ মে। তার বাবার নাম আ. রশীদ কাজী।

বড়বাড়িয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. সিদ্দিক মোল্লা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তুহিনের বাবা কৃষিকাজ করতেন। চার ভাই-বোনের মধ্যে তুহিন ছোট। এক ভাই কৃষিকাজ করলেও তাদের তেমন জমিজমা নেই। বড় ভাই তেমন কিছু করেন না। তবে কিছুদিন আগে তুহিন দুটো জমি ক্রয় করেছেন।

এছাড়া তাদের বাড়িতে কিছুদিন আগে দালান তৈরি করার জন্য ইটসহ বিভিন্ন মালামাল আনা হয়েছে বলে জানান এই জনপ্রতিনিধি।

এক প্রশ্নের জবাবে সিদ্দিক বলেন, তুহিনের বাবা খুব গরিব ছিল। তুহিন রাজনীতি করত না। সে পুলিশে যোগদান করার পর তাদের পরিবার স্বচ্ছল হতে শুরু করে। কিন্তু এভাবে এমন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে ভাবতেও পারিনি।

মশিউর রহমান তাপসের বাবার বাসা নেত্রকোণার মোহনগঞ্জের টেংগাপাড়া (পশ্চিম) গ্রামে। বাবার নাম আব্দুল মতিন। তাপস ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পুলিশের নিয়োগ পান এবং ২০২১ সালের ১৮ এপ্রিল শাহআলী থানায় যোগ দেন।

মোহনগঞ্জ থানার বড়তলী বানিয়া হাড়ি ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. মাসুদ মিয়া সাংবাদিকদের  বলেন, তাপসের বাবা আব্দুল মতিন এলাকার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে তাপস সবার বড়। তাপস ছাড়া পরিবারের সবাই এখন আমেরিকায় বসবাস করছে।

এই জনপ্রতিনিধি বলেন, তাপসের রাজনৈতিক কোনো পরিচয় ছিল না। এমএ পাস করার পরপরই পুলিশের চাকরি পেয়ে গেছে। সে এমন একটি কাজ করে বরখাস্ত হবে– সত্যিই ভাবা যায় না।

শাহআলী থানা এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা বলেছেন, এসআই তুহিন ও তাপস সব সময় নীল রঙের একটি গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করতেন, এলাকায় দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন।

ওই এলাকার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন,বরখাস্ত হয়েছে বলে বলছি না, ওই দুজনকে এলাকার মানুষ ভালো জানত না, তারা খামোখা ঝামেলা করত।

দুই পুলিশ সদস্যের আচরণও ‘অনেক খারাপ ছিল বলে মন্তব্য করলেন মাহমুদুর রহমান নামে একজন, তিনিও ওই এলাকায় থাকেন।

এলাকাবাসীর এ ধরনের বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শাহ আলী থানার পরিদর্শক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, তারা যে এসআই, সেটা তারা মনে করত না। নিজেদের মনমতো চলত। আমাদেরকে পাত্তা দিত না, শুধু ওসির সঙ্গে কথা বলত আর ডিউটি দিত।

নতুন ওসি আসার আগে শাহআলী থানার ওসি ছিলেন আমিনুল ইসলাম, তিনি এখন নিউ মার্কেট থানার দায়িত্বে। ২০২২ সালের ২৩ মে থেকে ২০২৩ সালের ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি শাহআলী থানার ওসি ছিলেন।  সাংবাদিকদের আমিনুল ইসলাম বলেন, দেড় বছরের মত শাহআলী থানায় ছিলাম। তাদের (তুহিন ও তাপস) চালচলনে খারাপ কিছু পাইনি। তবে তাপসের নীল রঙের একটি পুরাতন প্রাইভেটকার আমিও দেখেছি।

বর্তমান ওসি মওদুত হাওলাদার জানান, ৯ ডিসেম্বর দুপুর ২টা পর্যন্ত ডিউটি ছিল এসআই তুহিন ও তাপসের।

তারা ডিউটি শেষ করে অস্ত্রাগারে অস্ত্র জমা দিয়ে চলে যায়। রাতে আমার সাথে পরিচিতি পর্বে তারা আর আসেনি।

এর ছয় দিন পর শেরেবাংলা নগর থানায় এসআই তুহিন ও তাপসের বিরুদ্ধে মামলা করেন শাহাদাত হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী। তুলে নিয়ে গিয়ে তার মোবাইলে ব্যাংকের অ্যাপ ডাউনলোড করে সাত লাখের বেশি টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ করা হয় সেখানে।

মামলার এজাহারে শাহাদত বলেন, ৯ ডিসেম্বর বিকাল সোয়া ৩টার দিকে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচিত এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তাকে না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন। পথে একটি প্রাইভেট কার তার রিকশার গতি রোধ করে। পরে দুই এসআইসহ তিনজন প্রাইভেট কার থেকে নেমে এসে নিজেদের গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয় দিয়ে তাকে গাড়িতে তুলে নেয়।

প্রাইভেটকারে তুলে নেওয়ার পরপরই হাতকড়া এবং কালো কাপড় দিয়ে চোখ মুখ ঢেকে ফেলা হয়। পরে গাড়ির মধ্যেই মানিব্যাগ, মোবাইল ফোন এবং নগদ এক লাখ ৭০ হাজার টাকা নিয়ে নেয় তারা।

শাহাদতের ভাষ্য, ওই পুলিশ সদস্যরা তাকে একটি বাসায় নিয়ে যায়। এরপর মানিব্যাগে থাকা এটিএম কার্ড নিয়ে পিন কোড চায়, না দিলে মারধর করে। পরে পিন কোড নিয়ে বুথে গিয়ে ব্যালেন্স চেক করে ফিরে আসে। এসে তারা আমার মোবাইলে ‘নেক্সাস পে’ অ্যাপ ইনস্টল করে এবং সেখান থেকে সিটি ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টে তিন দফায় ৭ লাখ ৩৩ হাজার টাকা স্থানান্তর করে সাদা কাগজে সই নিয়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে মিরপুর ১ নম্বরে ছেড়ে দেয়।

মামলার এজাহারের যে সময়ে শাহাদাতকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, ওই সময় শাহআলী থানায় নতুন ওসির পরিচিতি পর্ব চলছিল, এসআই তুহিন ও তাপস সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।

তবে পরদিন থেকে তারা দুজনই শাহআলী থানায় স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করছিলেন। এরপর ১৯ ডিসেম্বর শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ চাঁদাবাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করে।

শাহ আলী থানার একজন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তুহিন ও তাপস যে ওই অপহরণকাণ্ডে জড়িত ছিলেন, সে বিষয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয় ঘটনার দিন তাদের মোবাইল ফোনের অবস্থান এবং সিসিটিভি ফুটেজ দেখে। পরে শেরেবাংলা নগর থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

শেরেবাংলা নগর থানার এসআই মো. আহাদ আলী সাংবাদিকদের  বলেন,শাহাদাতকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় দুই এসআই ছাড়াও আবু সুফিয়ান মোল্লা নামের এক বাস হেলপার ছিলেন। সুফিয়ানের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই শাহাদতকে টার্গেট করেন দুই এসআই।
এসআই তাপসের ব্যবহৃত নীল রঙের প্রাইভেট কারটি জব্দ করা হলেও তাদের কাছ থেকে কোনো টাকা পয়সা উদ্ধার করা যায়নি বলে জানান আহাদ আলী।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খ. মহিদ উদ্দিন সাংবাদিকদের  বলেন, ব্যক্তির দায় পুলিশ নেবে না। তারা ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। সেজন্য তাদেরকে বরখাস্ত করা হয়েছে আর আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
এ ধরনের ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে, সেজন্য পুলিশে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে মহিদ উদ্দিন বলেন, প্রশিক্ষণের সময় অনেক ধরনের মৌলিক শিক্ষা দেওয়া হয়, কী কী করতে পারবেন, আর কী কী করলে পুলিশ বাহিনী তার দায় নেবে না, তা ভালো করে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। তারপরও যারা বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।