ঢাকা অফিস: মেট্রোরেল এখন উড়ালপথে চলছে আগারগাঁও থেকে উত্তরা। মেট্রোরেলের এ লাইন গেল ডিসেম্বর মাসের শেষ সময়ে চালু হওয়ার পর শুরু হয় পাতালপথে মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের অপেক্ষা। অবসান ঘটতে চলছে সে প্রতীক্ষারও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ জানুয়ারি ফলক উন্মোচন করে মেট্রোরেলের পাতালপথ নির্মাণকাজ উদ্বোধন করবেন বলে মেট্রোরেল নির্মাণ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার রেললাইন মাটির নিচে নির্মিত হবে। এটিই মেট্রোরেলের প্রথম পাতাল যাত্রা। মেট্রোরেলের এ অংশ মাটির নিচ দিয়ে চলবে বলে এটি পাতাল রেল নামে পরিচিতি পাচ্ছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড- ডিএমটিসিএল বলছে, এ পর্বে এমআরটি লাইন-১ এর আওতায় পাতাল ও উড়ালপথসহ ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ করা হবে। এই পথে থাকবে দুটি রুট। একটি বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত, যার দৈর্ঘ্য হবে ২০ কিলোমিটার। এই রুটে ১২টি পাতাল স্টেশন থাকবে। বিমানবন্দর-কমলাপুর রুটই হবে দেশের প্রথম পাতাল রেলপথ। এটিও উত্তরা-আগারগাঁও রুটে চলাচলকরী মেট্রোরেলের আদলে বিদ্যুতে চলবে। নিয়ন্ত্রণ করা যাবে দূর থেকেই।
আর দ্বিতীয়টি হবে নতুন বাজার থেকে পিতলগঞ্জ ডিপো পর্যন্ত, যাকে পূর্বাচল রুট বলা হবে। দ্বিতীয় অংশের দৈর্ঘ্য ১১ কিলোমিটার। এর পুরোটাই উড়ালপথ। এই পথে স্টেশনের সংখ্যা নয়টি। পাতাল-উড়াল মিলিয়ে প্রতিটি স্টেশনে ট্রেন থামবে প্রতি আড়াই থেকে সাড়ে তিন মিনিট পরপর। এই ৩১ কিলোমিটার পথে চলবে ২৫টি ট্রেন। যার প্রতিটির একবারে তিন হাজারের বেশি যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা থাকবে।
পাতালপথে কমলাপুর, রাজারবাগ, মালিবাগ, হাতিরঝিল, রামপুরা, পূর্ব হাতিরঝিল, বাড্ডা, উত্তর বাড্ডা, নতুন বাজার, নর্দা, খিলখেত, বিমানবন্দর টার্মিনাল-৩ ও বিমানবন্দরে স্টেশন থাকবে। প্লাটফর্মে ওঠানামার জন্য উভয় পথের স্টেশনে থাকবে লিফট, সিঁড়ি ও এস্কেলেটর। তথ্যানুযায়ী, নতুন বাজার স্টেশনে এমআরটি লাইন-৫ নর্দার্ন রুটের সঙ্গে আন্তঃলাইন সংযোগ থাকবে। নর্দা ও নতুন বাজার স্টেশন আন্তঃসংযোগ রুট ব্যবহার করে বিমানবন্দর রুট থেকে পূর্বাচলে যাওয়া যাবে।
ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, আগামী বছর ২০২৪ সালের শেষ দিকে চালু হবে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল। পরের ধাপে নির্মাণ হবে মতিঝিল থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত। এতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড- ডিএমটিসিএল চেয়ারম্যান, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বুধবার রাতে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ২৬ জানুয়ারি মেট্রোরেলের পাতাল ও উড়ালপথ নির্মাণকাজ উদ্বোধন করবেন বলে সময় দিয়েছেন। সব ঠিক থাকলে ওই দিন বেলা ১১টায় পূর্বাচল এলাকার জনতা উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন খালি প্লটে এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে।’
সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী আরও বলেন, ‘উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সব প্রস্তুতি, প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে ইতোমধ্যেই। প্রতিমুহুর্তের আপডেট রাখছি। আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উদ্বোধনস্থল সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত করতে কাজ করে যাচ্ছেন। আমিও পরিদর্শন করছি। প্রতিদিনই উদ্বোধন প্রস্তুতি দেখভাল করছি। খতিয়ে দেখা হচ্ছে খুঁটিনাটি।’
এছাড়া উদ্বোধনী সময়ের কয়েকদিন আগেই সব প্রস্তুতি শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করে সচিব আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘যেহেতু প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করতে আসবেন, সেক্ষেত্রে প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি আছে কিনা, তা সম্পূর্ণ সতর্কতার সঙ্গে যাচাই করে দেখা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে সে বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপ বা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কীভাবে পরিচালিত হবে- সে বিষয়েও একাধিক সভা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখনও আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী সভা করছি প্রস্তুতি সঠিকভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে। ইতোমধ্যে উদ্বোধনী পর্বে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি বিভাগ ও অংশীজনদের সঙ্গে সমন্বিত বৈঠকও করেছি।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের এই সচিব।
মেট্রোরেল প্রকল্পের পরিচালক আবুল কাশেম ভূঞা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘পূর্বাচল জনতা উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন একটি খালি প্লটে লাইন-১ এর আওতায় পাতাল ও উড়াল রেল নির্মাণকাজ উদ্বোধনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর আগে রূপগঞ্জের পিতলগঞ্জে উদ্বোধন হওয়ার কথা থাকলেও জায়গা সংকুলান না হওয়ায় জনতা উচ্চ বিদ্যালয় এলাকা বেছে নেওয়া হয়েছে নির্মাণকাজের উদ্বোধনী পর্বের জন্য। এখানে যথেষ্ট খালি স্পেস (জায়গা) রয়েছে। অনুষ্ঠান পরিচালনায় কোনো ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হবে না বলে আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি। এরপর উদ্বোধনের জন্য নতুন স্থান বেছে নেওয়া হয়।’
ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, মেট্রোরেলের লক্ষ্য হচ্ছে রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় একটি রেল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা। যেন যানজটের ভোগান্তি এড়িয়ে নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন মানুষ। একই সঙ্গে মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ হলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন মাইলফলক সৃষ্টি হবে। সেই মাইলফলকের লক্ষ্যে পৌঁছাতে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে নির্মাণ কাজ। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার সবশেষ নির্ধারিত সময় ২০৩০ সালের আগেই প্রকল্পের আওতায় থাকা মেট্রোরেলের সব লাইন নির্মাণ শেষ করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সে হিসেবে সাত বছরের মধ্যেই সব লাইনে চলবে মেট্রোরেল। চলবে উড়াল পথে, ছুটবে পাতাল দিয়েও।
সূত্র মতে, এমআরটি লাইন-১ এর স্টাডি, সার্ভে, ডিটেইল ডিজাইনের কাজ শেষ হয়েছে। এই অংশের ডিপো নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। এছাড়া কয়েকটি স্টেশনের জমি অধিগ্রহণ কাজ চলমান। ২০২২ সালের অক্টোবর এ কাজের জন্য পরামর্শক নিয়োগের জন্য চুক্তি সই হয়। এ লাইনে প্রতিদিন প্রায় ১৯ লাখ যাত্রী পরিবহন করা যাবে। লাইনের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছাতে সময় লাগবে ২৪ মিনিট। যা এখন লাগে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে লাইনটির নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। সেই লক্ষ্যে ২০২২ সালে কাজ শুরুর কথা থাকলেও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে তা ফের পিছিয়ে যায়।
রাজধানীর যানজট কমিয়ে মানুষের যাতায়াত সহজ ও দ্রুত করার লক্ষ্যে বিশ্বের উন্নত দেশের মতো রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগে ২০১২ সালে সায় দেয় সরকার। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী মোট ছয় ধাপে মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনার প্রথম ধাপে গঠন করা হয় ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড-ডিএমটিসিএল। উড়াল ও পাতাল রেলপথ মিলিয়ে ছয়টি ধাপ রয়েছে। এমআরটি লাইন-৬, এমআরটি লাইন-১, এমআরটি লাইন-৫, এমআরটি লাইন-২, নর্দার্ন ও সাউদার্ন, এমআরটি লাইন-৪। এর মধ্যে এমআরটি লাইন-৬ দিয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়। যা ইতোমধ্যে শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, এমআরটি লাইন-৬, ১ ও ৫ এই তিন লাইন যথাক্রমে ২০২৫ সালের জুন, ২০২৬ সালের ডিসেম্বর এবং ২০২৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় বিলম্বের কারণে এমআরটি লাইন-১ ও ৫ এর কাজ শেষ হতে ২০৩০ সাল লেগে যেতে পারে।
এদিকে ২০২৮ সালের মধ্যে সাভারের হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত উড়াল-পাতাল মিলিয়ে মোট ২০ কিলোমিটার মেট্রোরেল পথ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে ১৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার হবে উড়াল এবং সাত কিলোমিটারে পাতাল রেলপথ নির্মাণ হবে। এই রুটের মোট ১৪টি স্টেশনের মধ্যে নয়টি উড়াল পথে আর পাঁচটি স্টেশন থাকবে পাতাল পথে।
এমআরটি লাইন-৫ নর্দার্ন রুট নামে পরিচিত এই অংশের সার্ভে কাজ চলছে এখন। ২০২৮ সালে লাইনটির নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ২০৩০ সাল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে জনিয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ। কারণ হিসেবে করোনা মহামারির কথা বলা হচ্ছে। এ কারণে দীর্ঘ সময় থেমে ছিল প্রকল্পের নির্মাণকাজ।
ঢাকায় মেট্রোরেল পথ নির্মাণের উদ্যোগের সূচনা হয় এমআরটি লাইন-৬ এর হাত ধরে। উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার মেট্রোরেল পথের ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটারের কাজ শেষ করা হয় প্রথম ধাপে। গেল বছরের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগাঁরগাও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনা। উদ্বোধনের পর ২৯ ডিসেম্বর থেকে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহন করছে মেট্রোরেল।