যশোর প্রতিনিধি
ভৈরব দেখার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে যশোরবাসীর। শহরের প্রাণস্পন্দন ভৈরব নদ খননের পর এটি এখন সরু এক খালে পরিণত হয়েছে। পরিবেশবিদরা দাবি করেছেন, খননের আগে যে অবস্থায় ছিল, আজ তা আরও মারাত্মক দূষণ-দুর্গন্ধের ভাগাড়ে রূপান্তরিত করে ভৈরবের প্রাণশক্তিকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে ভৈরব খননের সুফল পাওয়া শুরু হয়েছে। জোয়ারভাটাও হচ্ছে । কয়েকটি ছোট ব্রিজ সমপ্রসারণের কাজ করছে এলজিইডি। এগুলো হয়ে গেলে পুরোপুরি সুফল মিলবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০১৬ সালে ২৭২ কোটি টাকার ৯২ কিলোমিটার নদ খনন প্রকল্প গ্রহণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। শুরু হয় পাঁচ বছর মেয়াদি ‘ভৈরব রিভার বেসিন এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্প’। শহর অংশের চার কিলোমিটার এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ছাড়া খনন কাজ করা সম্ভব ছিল না। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ ৮৪টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। বাকি দেড় শতাধিক অবৈধ স্থাপনা আজও উচ্ছেদ হয়নি। সেই দখলদার রেখেই ভৈরব নদ খনন কাজ এখন শেষের পথে। নদের দুই ধারে হাঁটাচলা ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজও চলছে দখলদার রেখেই। উপরন্ত, দখলদারদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতেই নদ খননের মাটি দিয়ে পাড় বাঁধানোর পর সেখানে আবার সিমেন্টের বস্তা দিয়ে মজবুত করা হয়েছে। পাউবো জানায়, বর্তমান ম্যাপ অনুযায়ী নদের প্রস্থ শহরে ১৫০ মিটার এবং শহরের বাইরে ৩০০ মিটার।
তবে পরিবেশবাদীরা বলছেন, বাস্তবে নদ পরিণত হয়েছে সরু খালে। খননের মাটি দিয়েই পাড় বাঁধানো হয়েছে। এতে কমে গেছে নদের প্রশস্ততা। এরমধ্যে আবার নদের বুকে অপরিকল্পিত ৫১টি ব্রিজ কালভার্ট গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে।
ভৈরব নদ বাঁচাও আন্দোলনের উপদেষ্টা ইকবাল কবীর জাহিদ বলেন, আন্দোলনের ভিতর দিয়েই ভৈরব নদ খননের প্রকল্প গৃহীত হয়। এই নদই হলো দক্ষিণ-পশ্চিমা লের প্রধান নদী প্রবাহ। সেইদিক থেকে এই নদ যথাযথ খনন ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতীত কার্যকলাপে আদৌ সঠিকভাবে এই নদ খনন হবে কিনা, তা নিয়ে শুরু থেকেই সংশয়ে ছিলাম। আমাদের সেই সংশয় সত্যি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডিজাইন অনুযায়ীও এই ভৈবর নদ খনন হয়নি। কালক্ষেপণে নদের দুইপাড়ের দখলদাররা দুইভাবে সুবিধা নিচ্ছে। যশোরের মানুষ বিক্ষুব্ধ, আমরা চোখের সামনেই দেখছি, নদীর দুই পাড়ের যা বাড়িঘর আছে, তা থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করছে। অথচ তাদের স্যুয়ারেজ লাইন সব এই নদের ভিতরে। ফলে পানি দূষণের যে সংকট সেটাও লক্ষ্য করছি। অর্থাৎ ক্ষমতা দুর্নীতি মিলিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত এই প্রকল্প যে নয়ছয় করা যায় সেটা পানি উন্নয়ন বোর্ড করে দেখালো।
যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছোলজার রহমান বলেন, নদ খনন শেষ হলেও নদের নাব্যতা তো হয়ইনি, জোয়ারভাটা আসার প্রশ্নই পড়ে না। আগে নদের পানি একটু নড়াচড়া করত, দু-চারটে মাছের আনাগোনা দেখা যেত। এখন সেসবই অতীত। মশার আবাসস্থল, দূষণ-দুর্গন্ধ ভৈরবের প্রাণশক্তিকে কেড়ে নিয়েছে। নদের মধ্যে যে পাইলিং করা হচ্ছে, তা পুরাটাই নদ হত্যার সামিল। তিনি আরও বলেন, বাবলাতলা ব্রিজ থেকে বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল পর্যন্ত যে রাস্তা বানানো হয়েছে, তার পুরোটাই নদের বুকে। আবার তেতুলতলা কালভার্ট এবং ঢাকা ব্রিজের এক কিলোমিটার পূর্বদিকে মাদ্রাসার কাছে যে বালু তোলা হচ্ছে, তাতে খননের সুফলে যেভাবে উচ্ছসিত হয়েছিল মানুষ, তার উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে বাধ্য।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহিদুল ইসলাম বলেন, ভৈরব নদ খনন প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড নিয়ম মেনেই প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। প্রকল্পের সুফলও পেতে শুরু করেছে জনগণ। নদের অভ্যন্তরে পাইলিং প্রসঙ্গে বলেন, এটা নদের পাড় বাঁধানোর শিপমেন্টের জন্য করা হচ্ছে। দূষণের অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, স্যূয়ারেজ লাইনের মুখ নদীতে থাকলে, পানি দূষণ বন্ধ করা যাবে না। যারা এটা করছে, তাদের নোটিশ দেয়া হয়েছে। খুব শিগগিরই এ সংক্রান্ত কমিটি ব্যবস্থা নেবে।