যশোর মেডিকেল কলেজের যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্রের কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির সত্যতা মিলেছে

নিজস্ব প্রতিবেদক: যশোর মেডিকেল কলেজ যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্রের কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে বর্তমান ও সাবেক দুই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যার সত্যতা পেয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এর ফলে সাবেক দুজন অধ্যক্ষ গিয়াস উদ্দীন ও আখতারুজ্জামান দুই বছর আগে অবসরে গেলেও এখনো ছাড়পত্র পাননি।গিয়াস উদ্দীন ২০১৮ সালের ২৪ মার্চ থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন ও আখতারুজ্জামান ২০২০ সালের ১ জুলাই ও একই বছরের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে অবসরে যান।

যশোর মেডিকেল কলেজে লাশকাটা ঘর (মর্গ) নেই অথচ লাশ সংরক্ষণের জন্য ২২ লাখ টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে ‘মরচুয়ারি ক্যাবিনেট’ যন্ত্র। এছাড়াও চারটি লাশ সংরক্ষণ সুবিধার যন্ত্র গত তিন বছরের মধ্যে চালুই করা হয়নি।ফরেনসিক মেডিসিন অ্যান্ড টক্সিকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বাবলু কিশোর বিশ্বাস জানিয়েছেন, লাশের ময়নাতদন্ত করার জন্য কলেজে কোনো মর্গ স্থাপন করা হয়নি। মর্গ স্থাপনের আগেই লাশ সংরক্ষণের জন্য মরচুয়ারি ক্যাবিনেট যন্ত্র কেনা হয়েছে। যন্ত্রটি রাখার জন্য ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে জায়গাও নেই। যে কারণে অ্যানাটমি
বিভাগের কাছ থেকে একটি ঘর ধার নিয়ে যন্ত্রটি রাখা হয়েছে। শুধু এই মরচুয়ারি যন্ত্র নয়, অপ্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও আসবাব কিনে ফেলে রাখা হয়েছে। কোনো টেকনিশিয়ান না থাকায় অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থেকে যন্ত্রটি নষ্ট হচ্ছে।অন্তত দেড় কোটি টাকার আসবাব কেনা হয়েছে। রাখার জায়গা না থাকায় স্তূপ করা হয়েছে একটি কক্ষে।এসব যন্ত্র ও আসবাব কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির সত্যতা পেয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

জেলা স্বাস্থ্য সেবা ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন কমিটির সদস্য এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন জানিয়েছেন, কেনাকাটার নামে অর্থ আত্মসাৎ করা
হয়েছে। নিজস্ব ঠিকাদারের কাছ থেকে কমিশনের ভিত্তিতে কেনাকাটায় কোটি কোটি টাকা লুটপাট করা
হয়েছে। সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কলেজের
একাডেমিক ভবনের নিচতলায় অ্যানাটমি বিভাগের একটি ছোট কক্ষে তালাবদ্ধ অবস্থায় মরচুয়ারি ক্যাবিনেট যন্ত্র রাখা হয়েছে। কাচের দরজা দিয়ে ভেতরে
ধুলা ময়লার আস্তরণ দেখে বোঝা গেল দীর্ঘদিন ঘরটি খোলা হয় না। যন্ত্রটির কার্যকারিতা সম্পর্কে চিকিৎসক বাবলু কিশোর বিশ্বাস জানিয়েছেন, ‘মরচুয়ারি ক্যাবিনেট যন্ত্রে চারটি চেম্বার রয়েছে।যেখানে একই সঙ্গে চারটি মরদেহ সংরক্ষণ করা যায়। তিন বছর ধরে যন্ত্রটি ওই ঘরে রাখা আছে। যন্ত্রটি চালানোর মতো টেকনিশিয়ানও আমাদের নেই। যন্ত্রটি এখন নষ্ট।

মেডিকেল কলেজের হিসাব শাখা থেকে জানা যায় ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কলেজে চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ৮০ লাখ বরাদ্দ দেওয়া হয়।একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে মরচুয়ারি যন্ত্রটি কেনা হয়েছে। যন্ত্রটি চালু করার জন্য মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মো.মহিদুর রহমান গত ২১ আগস্ট গণপূর্ত বিভাগ যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে একটি চিঠি দেন।অধ্যক্ষ মহিদুর রহমান বলেন, ‘আমার আগের অধ্যক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত গিয়াস উদ্দীনের সময়ে যন্ত্রটি
কেনা হয়েছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই চালু করার চেষ্টা করছি। গণপূর্ত বিভাগ থেকে কক্ষের বাইরের দিকে একটি দরজা ও র‍্যাম্প সিঁড়ি নির্মাণ করে দিলেই যন্ত্রটি চালু করা যাবে।’
স্বাস্থ্য বিভাগের নিরীক্ষা দলের তদন্তে বলা হয়েছে,যন্ত্রপাতি, আসবাব ও গ্রন্থাগারে বইপত্র কেনাকাটায়
সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে। অধ্যক্ষ, হিসাবরক্ষক, উচ্চমান সহকারীরা কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন।এই কারণে দুজন অধ্যক্ষ গিয়াস উদ্দীন ও আখতারুজ্জামান
অবসরে গেলেও এখনো ছাড়পত্র পাননি।

বর্তমান অধ্যক্ষ মহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে কর্মস্থলে না থাকার অভিযোগ রয়েছে।প্রতি সপ্তাহে তিনি ছুটি ছাড়াই ফরিদপুরে পরিবারের কাছে চলে যান। দুই দিন পরে কর্মস্থলে ফেরেন।একাডেমিক
ভবনের ষষ্ঠ তলায় তিনি নিজের আবাসন করে নিয়েছেন। কলেজের ভবনে তাঁর বাসা থাকলেও কোনো
ধরনের ভাড়া পরিশোধ করেন না।দুই বছর ধরে তিনি এভাবেই কলেজে অবস্থান করছেন।অধ্যক্ষ মহিদুর মান বলেন,’আমার স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা ফরিদপুরে থাকে, এটা সত্য। সরকারি বিধি মেনেই প্রতি সপ্তাহে পরিবারের সদস্যদের কাছে যাই। কলেজের একাডেমিক ভবনের ষষ্ঠতলায় নিজস্ব ব্যবস্থায় একটি কক্ষে থাকি।’

হিসাব শাখা সূত্রে জানা যায়,তিন বছরে অন্তত পাঁচ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি, আসবাব ও গ্রন্থাগারের জন্য বই কেনা হয়েছে।এর মধ্যে দুই কোটি ৫৭ লাখ টাকার চিকিৎসাসংক্রান্ত যন্ত্রপাতি ৯০ লাখ টাকার বই ও দেড় কোটি টাকার আসবাব কেনা হয়েছে।