যশোর প্রতিনিধি
যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটির ছাতিয়ানতলা মল্লিক পাড়ায় ননী ফল নার্সারির আড়ালে ভুয়া চিকিৎসক খন্দকার কবীর হোসেনের ক্যান্সার ও যৌন চিকিৎসার নামে প্রতারণা থেমে নেই। ব্যবসা জোরদার করতে সোশ্যাল মিডিয়া ও ইউটিউবে প্রচারণা বাড়ানো হয়েছে। আবার আন্ডারগ্রাউন্ড টেলিভিশন ও ইউটিওবারদের ম্যানেজ করে পক্ষে সংবাদ প্রচার করানো হচ্ছে। বিগত দিনে প্রতারিত ভুক্তভোগীরা কবীরের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনসহ প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরে লিখিত অভিযোগ দিলেও এখনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। খন্দকার কবীরের জমপেশ প্রতারণা নিয়ে পত্রিকায় ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় সাংবাদিক বিল্লাল হোসেনের নামে চাঁদাদাবির মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছেন। প্রতারক কবীরের আটকের দাবিতে সাংবাদিক-জনতা মানববন্ধন করলেও রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, তারা অনেকেই খন্দকার কবীর হোসেনের প্রতারণার বিষয়টি জানতেন। কিন্তু ভয়ে মুখ খোলার সাহস পেতেন না। বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় তার প্রতারণা ফাঁস হয়েছে। তারা আরও জানান, ভুয়া চিকিৎসক খন্দকার কবীর হোসেনের প্রাতিষ্ঠানিক কোন ডিগ্রি না থাকার পরও যৌন সমস্যা, ক্যান্সারসহ সকল রোগ নিরাময়ের শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে মল্লিক পাড়ায় দেড় কোটি টাকার জমি ক্রয় করেছেন। সেখানে বহুতল ভবনের বাড়ির কাজ নির্মাণাধীন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় অনেকেই জানিয়েছেন, ননীফল নার্সারির আড়ালে কবীরের জমজমাট চিকিৎসা প্রতারণা দীর্ঘ দিনের। তিনি রাতের আধারে নার্সারির পাশের একটি টিন শেডের মধ্যে নিম গাছের পাতা, জিনসেং পাওডার, ননী ফল গাছের ছাল ও বাকল জ্বালিয়ে যৌন উত্তেজক ওষুধ মিশিয়ে বড়ি ও হালুয়া তৈরি করে। রাতেই সেগুলো বোতলে ভরা হয়। এরপর মানুষের দুর্বলতাকে পূঁজি করে চিকিৎসা প্রতারণা শুরু হয়। ভুয়া ওষুধ দিয়ে তিনি লোক ঠকিয়ে প্রতি মাসে ৩০ লক্ষাধিক টাকা আয় করছেন। ওষুধ প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই তিনি ওষুধ তৈরি করে থাকেন। শুধু মাত্র ইউনিয়ন পরিষদের ট্রেড লাইসেন্সের ওপর ভর করে চলছে কবীর হোসেনের কর্মকান্ড। তারা আরও জানান, তার প্রতারণা ফাঁস হওয়ার পর তার ব্যবসায় ধস নামে। কিন্তু বর্তমানে কবীর বিভিন্ন আন্ডারগ্রাউন্ড টেলিভিশন ও ইউটিওবারদের ম্যানেজ করে পক্ষে সংবাদ প্রচার করিয়ে ব্যবসা জোরদার করার চেষ্টা করছেন। সেই সাথে নিজের ফেসবুক পেজে যৌন চিকিৎসার নামে বিভিন্ন কুরুচিপূর্ন কথা বার্তার ভিডিও আপলোড করা হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বর্তমানে এলাকার একটি চক্রকে ম্যানেজ করে কোন প্রকার বাধা ছাড়াই চিকিৎসার নামে প্রতারণা ব্যবসা করার জন্য। চিকিৎসা নিতে আসা মানুষকে তিনি বলে থাকেন, একটা দুর্বল পুরুষের জন্য এই দুইটা ফাইল যথেষ্ট। জীবনে আর ওষুধ খেতে হবেনা। সে যত বড় সমস্যা হোক না কেনো। যৌন সমস্যা ছাড়াও চুলকানী, কষা, খিচা ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিক, পেটের গন্ডগোল, হজমের সমস্যা, লিভার নষ্ট, হৃদরোগ ও ক্যান্সারসহ নানা রোগের কাজ করে এই ওষুধ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শানতলা গ্রামের এক ব্যক্তি জানান, প্রতারক কবীরের লোভনীয় কথাবার্তায় মানুষ খুব সহজে বোকা বনে যাচ্ছে। তার এসব প্রতারণার প্রমানসহ প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরে বিগত দিনে লিখিত অভিযোগ করেও কোন ফল পাননি তিনি। প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরে লিখিত অভিযোগ কারী ওই ব্যক্তি আরও জানান, প্রকাশ্যে প্রতারণা করেও কবীর হোসেন ধরাছোয়ার বাইরে থেকেছেন। যেকারণে তার মতো অনেকেই প্রশাসনের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন। সর্বশেষ গত ৪ এপ্রিল কবীরের অপচিকিৎসার শিকার যশোর শহরের ঘোপ নওয়াপাড়া রোডের বাসিন্দা দুই জন জেলা প্রশাসক , সিভিল সার্জন এবং ওষুধ প্রশাসনের তত্ত্বাবধায়কের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে বলা হয়, খন্দকার কবীর হোসেন নামে একজন প্রতারক। সরল মনে তাকে বিশ্বাস করে বিশেষ রোগের চিকিৎসা গ্রহনের জন্য দুই মাস আগে তার স্বরনাপন্ন হয়েছিলেন। তিনি সমস্যার শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে ওষুধ (যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট ও হালুয়া) দিয়েছিলেন। বিনিময়ে ৩ হাজার টাকা করে দুই জনের কাছ থেকে মোট ৬ হাতিয়ে নেন। ওই সময় কবীর হোসেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ওষুধে কাজ না হলে টাকা ফেরত দেবেন। তার নির্দেশনা অনুযায়ী ওষুধ সেবন করেন। কিন্তু ওষুধ সেবনের পর কাজের কাজ হয়নি। বরং তারা শারীরিকভাবে আরও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। পরে টাকা ফেরত চাইলেও দেয়া হয়নি। এরপরেও প্রতারক কবীর রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ছাতিয়ানতলা গ্রামের সরদার পাড়ার মিঠু জানান, খন্দকার কবীর হোসেন একজন চিহ্নিত প্রতারক ও ভুয়া চিকিৎসক। ননী ফল নার্সারি হলো তার সাইনবোর্ড মাত্র। ননী ফল নার্সারিকে পূঁজি করে চলে তার মানুষ ঠকানোর ব্যবসা। তিনি আরও জানান, প্রশাসনের চোখে ধুলো দেয়ার জন্য ধুরন্ধর কবীর হোসেন ননী ফল নার্সারির সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে যত সব অপকর্ম করছেন। যৌন সমস্যা, চুলকানী, কষা, খিচা ডায়াবেটিস, গ্যাস্ট্রিক, পেটের গন্ডগোল, হজমের সমস্যা, লিভার নষ্ট, হৃদরোগ ও ক্যান্সারসহ নানা রোগের চিকিৎসা করেন তিনি। কারো রোগ সেরেছে এমন কোন তথ্য তার জানা নেই।
চুড়ামনকাটি গ্রামের মুকুল হোসেন জানান, কবীরের নার্সারি ব্যবসাকে তিনি সাধুবাদ জানান। কিন্তু নার্সারির আড়ালে চিকিৎসার নামে মানুষের সাথে প্রতারণা করার বিষয়টি অবশ্যই অন্যায়। প্রশাসনের কাছে তার দাবি কবীরের চিকিৎসার প্রতারণার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
চুড়ামনকাটি প্রেসক্লাবের সভাপতি আনিসুর রহমান জানান, পত্রিকায় ধারাবাহিক খবর প্রকাশ হওয়ায় প্রতারক কবীর বেসামাল হয়ে পড়েন। তিনি নিজের চিকিৎসা প্রতারণা ও অপকর্ম আড়াল করার জন্য সাংবাদিক বিল্লাল হোসেনের নামে চাঁদাদাবির মিথ্যা মামলা করেছেন। মামলার প্রতিবাদে ৩ এপ্রিল চুড়ামনকাটির সাংবাদিক- জনতা প্রতারক কবীরের আটকের দাবিতে মানববন্ধন করে।
এই বিষয়ে খন্দকার কবীর হোসেন জানান, তার কোন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নেই। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ওষুধ তৈরি করেন। মানুষের চিকিৎসা সেবা দেন। তার এখানে কয়েকশ’ প্রকারের বিদেশী গাছ আছে। কোন গাছে কি রোগের কাজ করে এটা তার মুখস্ত।
ওষুধ প্রশাসন যশোরের তত্ত্বাবধায়ক নাজমুল ইসলাম জানান, খন্দকার কবীর হোসেন একজন প্রতারক বলে অভিযোগ পেয়েছি। তিনি কখনো সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, কখনো চিকিৎসক বলে ননী ফল নার্সারির অন্তরালে মানুষের সাথে প্রতারণা করে চলেছেন। কবীরের প্রতারণার বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে।
যশোরের সিভিল সার্জন ডা. বিপুল কান্তি বিশ্বাস জানান, খন্দকার কবীরের অপচিকিৎসার শিকার প্রতারিত দুইজনের লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে। চিকিৎসা প্রতারণার প্রমান মিললে ভ্রাম্যমান আদালত সাথে নিয়ে কবীরের ডেরায় অভিযান পরিচালনা করা হবে।
যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান জানান, কবীর হোসেনের চিকিৎসা প্রতারণার বিষয়টি খোঁজ নেয়ার জন্য সিভিল সার্জনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।